Search

পিএমইন্ডিয়াপিএমইন্ডিয়া

সাম্প্রতিক সংবাদ

বিষয়টিকে সরাসরি পিআইবি থেকে নেওয়া হয়েছে

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী সমারোহ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী সমারোহ উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ


নয়াদিল্লি, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২০

 

নমস্কার,

“হে বিধাতা, দাও দাও মোদের গৌরব দাও, দুঃসাধ্যের নিমন্ত্রণে, দুঃসহ দুঃখের গর্বে”

গুরুদেব কখনও এই প্রার্থনা ছাত্রছাত্রীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য করেছিলেন। আজ বিশ্বভারতীর গৌরবময় শতবর্ষে আমার সঙ্গে গোটা দেশ এই মহান প্রতিষ্ঠানের জন্য এই প্রার্থনা করছে। “হে বিধাতা, দাও দাও মোদের গৌরব দাও, দুঃসাধ্যের নিমন্ত্রণে, দুঃসহ দুঃখের গর্বে”।

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল শ্রী জগদীপ ধনকড়জি, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ডঃ রমেশ পোখরিয়াল নিশাঙ্কজি, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিদ্যুৎ চক্রবর্তীজি, সমস্ত অধ্যাপক-অধ্যাপিকা, রেজিস্ট্রার, সমস্ত শিক্ষকগণ, ছাত্রছাত্রী, প্রাক্তনী, ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ,

এই বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ প্রত্যেক ভারতবাসীর জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। আমার জন্য এটি অত্যন্ত আনন্দের যে আজকের দিনে এই তপভূমির উৎসবে অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছি।

বন্ধুগণ,

বিশ্বভারতীর শতবর্ষের যাত্রাপথ অত্যন্ত বিশেষ। বিশ্বভারতী, ভারতমাতার জন্য গুরুদেবের ভাবনা-চিন্তা, দর্শন ও পরিশ্রমের ফসল। ভারতের জন্য গুরুদেব যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য, দেশকে নিরন্তর প্রাণশক্তি জোগানোর জন্য বিশ্বভারতী একটি আরাধ্য স্থান। অনেক বিশ্বখ্যাত গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিদ, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতি অনেক প্রতিভা ভারতকে দিয়েছে বিশ্বভারতী । নতুন ভারত নির্মাণের জন্য তাঁরা নিত্যনতুন চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই প্রতিষ্ঠানকে এই উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া প্রত্যেকটি মানুষকে আমি সাদর প্রণাম জানাই। তাঁদের অভিনন্দন জানাই। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে বিশ্বভারতী, শ্রীনিকেতন এবং শান্তিনিকেতন নিরন্তর গুরুদেব নির্ধারিত লক্ষ্যগুলি প্রাপ্তির চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিশ্বভারতী অনেক গ্রামের উন্নয়নে কাজ করে গ্রামোদয়ে যে সাফল্য পেয়েছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আপনারা ২০১৫ সালে যে যোগ বিভাগ শুরু করেছিলেন, তার জনপ্রিয়তাও দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে অধ্যয়ন এবং জীবন – উভয়ের সাক্ষাৎ উভয়ের উদাহরণ আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে পাওয়া যায়। আপনারাও হয়তো এটা দেখে অত্যন্ত আনন্দিত যে আমাদের দেশ বিশ্বভারতীর ইতিবাচক বার্তাগুলিকে গোটা বিশ্বে পৌঁছে দিচ্ছে। ভারত আজ আন্তর্জাতিক সৌর জোটের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভারত আজ গোটা বিশ্বে একমাত্র বড় দেশ যেটি প্যারিস চুক্তিতে ধার্য করা পরিবেশের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সঠিক পথে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।

বন্ধুগণ,

আজ যখন আমরা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পালন করছি, তখন সেই পরিস্থিতি স্মরণ করা প্রয়োজন যখন এর ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল। সেই পরিস্থিতিগুলি যে শুধুই ইংরেজদের দাসত্বের কারণেই জন্ম নিয়েছিল তা নয়, এর পেছনে ছিল শত শত বছরের অভিজ্ঞতা, শত শত বছরের বিভিন্ন আন্দোলনের প্রেক্ষিত। আজ আপনাদের মতো বিদ্বজ্জনদের মাঝে এই বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করছি, কারণ এই বিষয়টি নিয়ে খুব কম বলা হয়েছে, খুব কম লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত প্রয়োজন, কারণ, এটি সরাসরি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং বিশ্বভারতীর লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত।

বন্ধুগণ,

আমরা যখন স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বলি, তখন আমাদের সরাসরি ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর মনে পড়ে। কিন্তু এটাও সত্য যে এই আন্দোলনের ভিত্তি অনেক আগেই স্থাপিত হয়েছিল। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন অনেক শতাব্দী আগে থেকেই শুরু হয়েছে, অনেক শতাব্দী আগে থেকেই জারি রয়েছে, অনেক আন্দোলন থেকে তা প্রাণশক্তি নিয়েছে। ভারতের আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক ঐক্যকে শক্তিশালী করার কাজ করেছে ভক্তি আন্দোলন । ভক্তি যুগে, ভারতের প্রত্যেক ক্ষেত্রে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ – প্রত্যেক দিকে আমাদের সাধু-সন্ন্যাসী-মহন্ত-আচার্যরা দেশের চেতনা জাগ্রত রাখার জন্য অবিরত, অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। যদি দক্ষিণের কথা বলি, মধ্বাচার্য, নিম্বার্কাচার্য, বল্লভাচার্য ও রামানুজাচার্য – এই ভক্তি আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। পশ্চিম ভারতে মীরাবাঈ, একনাথ, তুকারাম, রামদাস, নরসী মেহতা, যদি উত্তরের দিকে তাকাই তাহলে সন্ত রামানন্দ, কবীরদাস, গোস্বামী তুলসীদাস, সুরদাস, সন্ত রবিদাস এবং গুরুনানক দেবের মতো অসংখ্য মহাপুরুষ। পূর্বের দিকে যদি তাকাই, এত নাম রয়েছে বিশেষ করে চৈতন্য মহাপ্রভূ, এবং শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের মতো সাধুদের ভাবনা থেকে সমাজ প্রাণশক্তি পেয়ে এসেছে। ভক্তিকালের সেই সময়ে রসখান, সুরদাস, মালিক মহম্মদ, জায়সী, কেশবদাস বিদ্যাপতি – না জানি কত মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন যাঁরা নিজেদের রচনার মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার এবং উন্নয়নের পথ দেখিয়েছেন। ভক্তিকালের এই পুণ্যাত্মারা প্রতিটি মানুষের মনে ঐক্যের ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। সেজন্য এই আন্দোলন প্রত্যেক ক্ষেত্রীয় সীমার ঊর্ধ্বে উঠে ভারতের কোণায় কোণায় পৌঁছে গেছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতীয় ভক্তির অধিষ্ঠানে আত্মাভিমান এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। ভক্তি আন্দোলন হল সেই সুতো, যা কয়েক শতাব্দী ধরে সংঘর্ষরত ভারতীয়দের সামগ্রিক চেতনা ও আত্মবিশ্বাসে ভরে দিয়েছে।

বন্ধুগণ,

মহান কালীভক্ত শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস জনমনে প্রভাব বিস্তার করার আগে পর্যন্ত দেশে এই ভক্তি আন্দোলন এগিয়ে চলেছে। এই মহান সাধু, যাঁর কাছ থেকে ভারত স্বামী বিবেকানন্দ পেয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ ভক্তি, জ্ঞান ও কর্ম – এই তিনটি বিষয়কেই নিজের মধ্যে আত্মস্থ করেছিলেন। তিনি ভক্তির পরিধি বৃদ্ধি করে প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে দিব্যতা দেখা শুরু করেন। তিনি ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান নির্মাণে গুরুত্ব দিয়ে কর্মকেও অভিব্যক্তি দিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন।

বন্ধুগণ,

ভক্তি আন্দোলনের কয়েকশ’ বছর সময়কালে ভক্তির পাশাপাশি দেশে কর্ম-আন্দোলনও জারি ছিল। কয়েক শতাব্দী ধরে ভারতের জনগণ দাসত্ব ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ থেকে শুরু করে মহারাণা প্রতাপ, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, কিত্তুরের রানি চেনাম্মা কিংবা ভগবান বিরসা মুন্ডার সশস্ত্র সংগ্রাম। অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ নাগরিকের তপস্যা, ত্যাগ, তর্পণের কর্ম এবং কঠোর সাধনা চরমে পৌঁছেছিল। এইসবই ভবিষ্যতে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেক বড় প্রেরণা হয়ে আসে।

বন্ধুগণ,

ভক্তি এবং কর্মধারার এই প্রেক্ষিতে নবজাগরণের জ্ঞানের সরিতা যুক্ত হওয়ায় এই নতুন ত্রিবেণী সঙ্গম স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনা তৈরি করেছিল। স্বাধীনতার স্পৃহায় ভক্তির প্রেরণা ভরপুর ছিল। সময়ের চাহিদা ছিল, জ্ঞানের প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনতা সংগ্রাম জেতার জন্য ভাবনা-চিন্তায় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আর পাশাপাশি, একটি উজ্জ্বল ভাবী ভারত নির্মাণের জন্য নতুন প্রজন্মকে প্রস্তুত করতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। সেই সময় প্রতিষ্ঠিত অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, ন্যাশনাল কলেজ যা এখন লাহোরে রয়েছে, মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিচি ন্যাশনাল কলেজ, মহাত্মা গান্ধী কাশী বিদ্যাপীঠ, গুজরাট বিদ্যাপীঠ, ওয়েলিংটন কলেজ, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয়, আন্নামলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অনেক প্রতিষ্ঠান সেই সময় দেশে স্থাপিত হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ভারতের একটি নতুন বিদ্যাচর্চার ধারা বিকশিত হয়েছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনকে নতুন প্রাণশক্তি জুগিয়েছে, নতুন লক্ষ্য প্রদান করেছে, নতুন উচ্চতা প্রদান করেছে। ভক্তি আন্দোলনে আমরা একত্রিত হয়েছি। জ্ঞান আন্দোলন ভাবনা-চিন্তাকে শক্তিশালী করেছে। আর কর্ম আন্দোলন আমাদের নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই করার উদ্যম ও সাহস জুগিয়েছে। কয়েকশো বছর সময় ধরে চলতে থাকা এই আন্দোলন ত্যাগ, তপস্যা ও তর্পণের অনুপম উদাহরণ হয়ে রয়েছে। এই আন্দোলনের প্রভাবিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মবলিদানের জন্য একের পর এক এগিয়ে আসতে থাকেন।

বন্ধুগণ,

জ্ঞানের এই আন্দোলনকে গুরুদেবের প্রতিষ্ঠা করা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় নতুন প্রাণশক্তি দিয়েছে। গুরুদেব যেভাবে ভারতের সংস্কৃতি ও আমাদের পরম্পরাকে যুক্ত করে বিশ্বভারতীকে যে স্বরূপ দিয়েছেন, তা রাষ্ট্রবাদের একটি শক্তিশালী পরিচয় দেশের সামনে রেখেছে। পাশাপাশি, তিনি বিশ্ব বন্ধুত্বের ওপরও ততটাই জোর দিয়েছেন।

বন্ধুগণ,

বেদ থেকে শুরু করে বিবেকানন্দ পর্যন্ত ভারতীয় দর্শনের প্রতিটি ধারা গুরুদেবের রাষ্ট্রবাদের ভাবনাচিন্তায় মুখর হয়ে উঠেছিল। আর এই ধারা অন্তর্মুখী ছিল না। এই ধারা ভারতকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার ধারা ছিল না। তাঁর দৃষ্টিকোণ ছিল যা কিছু ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ – তার দ্বারা বিশ্ব লাভবান হোক। আর যা কিছু বিশ্বের ভালো, তা থেকে ভারত শিক্ষা গ্রহণ করুক। আপনারা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামেই দেখুন – বিশ্বভারতী! ভারত মাতার সঙ্গে বিশ্বের সমন্বয়। গুরুদেব সর্বসমাবেশী ও সর্বস্পর্শী সহঅস্তিত্ব এবং সহযোগের মাধ্যমে মানব কল্যাণের বৃহৎ লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে গেছেন। বিশ্বভারতীর জন্য গুরুদেবের এই দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের ‘আত্মনির্ভর ভারত’ – এরও সারকথা। আত্মনির্ভর ভারত অভিযানও বিশ্বকল্যাণের জন্য ভারতের কল্যাণের পথ। এই অভিযান ভারতকে শক্তিশালী করে তোলার অভিযান। ভারতের সমৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বে সমৃদ্ধি আনার অভিযান। ইতিহাস সাক্ষী আছে, শক্তিশালী ও আত্মনির্ভর ভারত সর্বদাই সারা বিশ্বে মানব সভ্যতার কল্যাণসাধন করেছে। আমাদের উন্নয়ন একক নয় – বিশ্বজনীন, সমগ্র এবং এই সামগ্রিকতার বোধই আমাদের শিরা-ধমনীতে প্রবাহিত। ‘সর্বে ভবন্তু সুখীন’’র ভাবধারা। ভারত ও বিশ্বের এই সম্পর্ক আপনাদের চেয়ে ভালো আর কে জানেন! গুরুদেব আমাদের স্বদেশী সমাজের সংকল্প দিয়েছিলেন। তিনি আমাদের গ্রামগুলিকে, আমাদের কৃষিকে আত্মনির্ভর দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি আত্মনির্ভরতার লক্ষ্য সিদ্ধ করার জন্য আত্মশক্তির কথা বলেছেন। আত্মশক্তির প্রাণশক্তি নিয়ে রাষ্ট্রনির্মাণ নিয়ে তিনি যা বলেছেন, তা আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছেন, রাষ্ট্রের নির্মাণ ব্যক্তির থেকে নিজের আত্মার প্রাপ্তিরই বিস্তার-স্বরূপ। যখন আপনারা নিজেদের ভাবনায়, কাজের মাধ্যমে, নিজেদের কর্তব্য সম্পাদনের মাধ্যমে দেশ নির্মাণ করেন, তখন আপনাদের দেশের আত্মার মধ্যেই নিজেদের আত্মাকে পরিলক্ষিত হতে দেখেন।

বন্ধুগণ,

ভারতের আত্মা, ভারতের আত্মনির্ভরতা এবং ভারতের আত্মসম্মান পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। ভারতের আত্মসম্মান রক্ষার জন্য বাংলার মানুষ কয়েক প্রজন্ম ধরে নিজেদের আত্মোৎসর্গ করেছিলেন। স্মরণ করুন ক্ষুদিরাম বসুকে, যিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফাঁসিকাঠে চড়েছিলেন। প্রফুল্ল চাকী মাত্র ১৯ বছর বয়সে শহীদ হয়েছিলেন। বীণা দাস, যাঁকে বাংলার অগ্নিকন্যা বলা হ’ত, মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁকে জেলে পাঠানো হয়েছিল। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। এরকম অসংখ্য স্বাধীনতা সংগ্রামী রয়েছেন, যাঁদের নাম হয়তো ইতিহাসেও লেখা হয়নি, তাঁরা সবাই দেশের আত্মসম্মান রক্ষার জন্য হাসতে হাসতে মৃত্যুকে আলিঙ্গণ করেছিলেন। আজ তাঁদের থেকেই প্রেরণা নিয়ে আমাদের আত্মনির্ভর ভারতের জন্য বাঁচতে হবে, এই সংকল্পকে বাস্তবায়িত করতে হবে।

বন্ধুগণ,

ভারতকে শক্তিশালী ও আত্মনির্ভর করার ক্ষেত্রে আপনাদের প্রত্যেকের প্রতিটি অবদান গোটা বিশ্বকে একটি উন্নত স্থানে পরিণত করবে। ২০২২ সালে ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। বিশ্বভারতী স্থাপনের ২৭ বছর পর ভারত স্বাধীন হয়েছিল, আর এখন থেকে ২৭ বছর পর ভারত তার স্বাধীনতার শতবর্ষ পালন করবে। সেই শতবর্ষের দিকে তাকিয়ে আমাদের নতুন লক্ষ্য স্থির করতে হবে। নতুন প্রাণশক্তি জোগাতে হবে, নতুনভাবে নিজেদের যাত্রা শুরু করতে হবে। আর এই যাত্রাপথে আমাদের পথপ্রদর্শক আর কেউ নন, গুরুদেবের কথাগুলি ও তাঁর দর্শনই আমাদের আলোকবর্তিকা হবে। আর যখন আমরা প্রেরণা পাই, সংকল্প থাকে, তখন লক্ষ্যও নিজে থেকে তৈরি হয়ে যায়। বিশ্বভারতী প্রসঙ্গে যদি বলি, এখানে এ বছর ঐতিহাসিক পৌষ মেলার আয়োজন সম্ভব হয়নি। ১০০ বছরের যাত্রাপথে তৃতীয়বার এমন হয়েছে। এই মহামারী আমাদের সামনে এই মূল্যবোধই তুলে ধরেছে – ‘ভোকাল ফর লোকাল’। পৌষ মেলার সঙ্গেও এই মন্ত্র সর্বদাই যুক্ত ছিল। মহামারীর ফলেই মেলায় যে শিল্পীরা আসতেন, যে হস্তশিল্পীরা আসতেন, তাঁরা এবার আসতে পারেননি। আমরা যখন আত্মসম্মানের কথা বলি, আত্মনির্ভরতার কথা বলি, এই প্রেক্ষিতে সবার আগে আমি আপনাদের অনুরোধ জানাই, আপনারা আমাকে একটি সাহায্য করুন, আমার হয়ে বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রীরা প্রতি বছর মেলায় যে শিল্পীরা আসেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তাঁদের উৎপাদিত পণ্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করুন। আর এই গরিব হস্তশিল্পীদের তৈরি নানা জিনিস কিভাবে অনলাইনে বিক্রি হতে পারে, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কিভাবে সাহায্য করা যেতে পারে, তা দেখুন। এদিকে মনোযোগ দিন। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতেও স্থানীয় শিল্পী ও হস্তশিল্পীদের উৎপাদিত পণ্য যাতে বিশ্ব বাজারে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে, সেজন্য তাঁদেরকে শেখান। তাঁদের পথ প্রশস্ত করুন। এ ধরনের অনেক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই দেশ আত্মনির্ভর হয়ে উঠবে। আমরা গুরুদেবের স্বপ্নগুলিকে বাস্তবায়িত করতে পারবো। আপনারা গুরুদেবের সবচেয়ে প্রেরণাদায়ী মন্ত্র তো জানেনই। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’। কেউ সঙ্গে না এলেও নিজেদের লক্ষ্য প্রাপ্তির জন্য একা চলতে হলে চলবেন।

বন্ধুগণ,

গুরুদেব অনেক দশক আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সেই ভবিষ্যদ্বাণী কী? তিনি বলেছিলেন, ওরে নতুন যুগের ভোরে দিসনে সময় করিয়ে বৃথা সময় বিচার করে, ওরে নতুন যুগের ভোরে, এসো জ্ঞানী এসো, কর্মী এসো ভারতের লাজ হে, বীরধর্মে পুণ্যকর্মে বিশ্বহৃদয় রাজ রে! গুরুদেবের এই উপদেশকে, এই উদঘোষকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব আমাদের সকলের।

বন্ধুগণ,

গুরুদেব শুধু একটি শিক্ষা লাভের কেন্দ্র রূপে বিশ্বভারতীকে স্থাপন করেননি। তিনি একে শিক্ষার আসন, শিক্ষার একটি পবিত্র স্থান রূপে দেখতেন। পড়াশুনো করা এবং শেখা উভয়ের মাঝে যে পার্থক্য রয়েছে, গুরুদেবের শুধুমাত্র একটি বাক্য থেকে বোঝা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, “আমার মনে নেই, আমাকে কী পড়ানো হয়েছিল। আমার শুধু ততটুকুই মনে আছে, যতটা আমি শিখেছিলাম”। এই বাক্যকে আরেকটু বিস্তারিত করে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “সবচেয়ে বড় শিক্ষা সেটাই, যা শুধু আমাদের তথ্যে সমৃদ্ধ করবে না, আমাদেরকে সকলের সঙ্গে বাঁচতে শেখাবে”। তিনি সারা বিশ্বের জন্য বার্তা দিয়েছিলেন যে, “আমাদের জ্ঞানকে কোনও অঞ্চলের মধ্যে কোনও সীমার মধ্যে বেঁধে রাখার চেষ্টা করা উচিৎ নয়”। তিনি যজুর্বেদের মন্ত্রকে বিশ্বভারতীর মন্ত্র বানিয়েছিলেন। “য়ত্র বিশ্বম ভবত্যেক নীড়ম” অর্থাৎ “যে খানে গোটা বিশ্ব একটি নীড়ে পরিণত হবে একটি পাখির বাসার মতো হবে সেই স্থান যেখানে নিত্য নতুন অনুসন্ধান হবে, সেই স্থান, যেখানে সবাই মিলে এগিয়ে যাবে”। আর যেমন এখন আমাদের শিক্ষা মন্ত্রী বিস্তারিতভাবে বলছিলেন, গুরুদেব বলতেন, “চিত্ত যেথা ভয় শূন্য উচ্চ যেথা শির, জ্ঞান যেথা মুক্ত…” আমাদের এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে আমাদের মনে কোনও ভয় থাকবে না। আমাদের মাথা উঁচু থাকবে এবং জ্ঞান সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হবে। আজ দেশ নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে সেই উদ্দেশ্য পূরণেরও চেষ্টা করছে। এই শিক্ষা নীতি বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে বিশ্বভারতীর বড় ভূমিকা রয়েছে। আপনাদের কাছে ১০০ বছরের অভিজ্ঞতা আছে, পাণ্ডিত্য আছে, দিশা আছে, দর্শন আছে আর গুরুদেবের আশীর্বাদ তো আছেই। যত বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই বিষয়ে বিশ্বভারতীর বার্তালাপ আদানপ্রদান হবে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলিরও এই দৃষ্টিভঙ্গী বুঝতে সুবিধা হবে।

বন্ধুগণ,

আমি যখন গুরুদেব সম্পর্কে কথা বলি, তখন একটি মোহ থেকে নিজেকে সামলাতে পারি না। গতবার আপনাদের এখানে যখন এসেছিলাম, তখনও আমি এ বিষয়ে কিছুটা বলেছিলাম। আমি আরেকবার গুরুদেব ও গুজরাটের আত্মীয়তাকে স্মরণ করাতে চাই। এটা বারবার স্মরণ করানো অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ, এটা আমাদের ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ – এর ভাবনায় সম্পৃক্ত করে। এটা দেখায় যে, নানা ভাষা, কথ্যভাষা, খাদ্যাভাস, পরিধান কতটা পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এটা দেখায় যে কিভাবে বৈচিত্র্যে ভরা আমাদের দেশ ঐক্যবদ্ধ এবং পরস্পরের থেকে প্রতিনিয়ত অনেক কিছু শিখতে থাকে।

বন্ধুগণ,

গুরুদেবের বড় ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন আইসিএস হয়েছিলেন, তাঁর নিযুক্তি গুজরাটের আমেদাবাদেই হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায়ই গুজরাট যেতেন। সেখানে তিনি দীর্ঘসময় কাটিয়েছেন। আমেদাবাদে থাকার সময় তিনি তাঁর জনপ্রিয় বাংলা কবিতা “বন্দী ও আমার” আর “নীরব রজনী দেখো” লিখেছিলেন। তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘ক্ষুধিত পাষান’-এর একটা অংশও তিনি গুজরাট থাকাকালীন সময়ে লিখেছিলেন। শুধু তাই নয়, গুজরাটের এক কন্যা শ্রীমতী হটিসিংগ গুরুদেবের বাড়িতে বধূ হয়ে গিয়েছিলেন। এছাড়া, আরেকটি তথ্য আছে, যা আমাদের নারী ক্ষমতায়নের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলির পড়া উচিৎ, তা হ’ল – সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদিনী দেবী যখন আমেদাবাদে ছিলেন, তিনি দেখেছিলেন যে, স্থানীয় মহিলারা তাঁদের শাড়ির আঁচল ডান কাঁধে রাখেন। এখন ডান কাঁধে আঁচল রাখা সেই মহিলাদের কাজ করতে কিছু সমস্যা হ’ত। এটা দেখে জ্ঞানদিনী দেবী একটি বুদ্ধি বের করেন – শাড়ির আঁচলকে বাম দিকের কাঁধে রাখলে হয় না! আমার ঠিক জানা নেই, কিন্তু বলা হয়, বাম কাঁধে শাড়ির আঁচল রেখে শাড়ি পরা তাঁরই উদ্ভাবন। পরস্পরের কাছ থেকে শিখে পরস্পরের আনন্দে সামিল হয়ে একটি পরিবারের মতো থেকেই আমরা সেই স্বপ্নগুলি বাস্তবায়িত করতে পারি, যে স্বপ্নগুলি দেশের মহান মনীষীরা দেখে গেছেন। এই শিষ্টাচার গুরুদেবও বিশ্বভারতীকে দিয়েছেন। এই শিষ্টাচারগুলিকেই আমাদের সবাইকে মিলেমিশে শক্তিশালী করে তুলতে হবে।

বন্ধুগণ,

আপনারা সবাই যেখানেই যাবেন, যেক্ষেত্রেই যাবেন – আপনাদের পরিশ্রমের মাধ্যমেই একটি নতুন ভারত গড়ে উঠবে। আমি গুরুদেবের পঙক্তি দিয়েই আমার বক্তব্য শেষ করবো, গুরুদেব বলেছিলেন, “ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগলো যে দোল, স্থলে জলে বনতলে লাগলো যে দোল, দ্বার খোল দ্বার খোল”! দেশের নতুন সম্ভাবনাগুলির দরজা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আপনারা সবাই সফল হোন, এগিয়ে যান আর দেশের স্বপ্নগুলি বাস্তবায়িত করুন – এই শুভকামনা জানিয়ে আপনাদের সবাইকে আরেকবার অনেক অনেক ধন্যবাদ। আর এই শতাব্দী বর্ষ আমাদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যেন একটি শক্তিশালী মাইলফলক হয়ে ওঠে, আমাদের নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়! বিশ্বভারতী যে স্বপ্নগুলি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছিল, সেই স্বপ্নগুলি বাস্তবায়িত করে বিশ্ব-কল্যাণের পথকে প্রশস্ত করার জন্য ভারতের কল্যাণের পথ শক্তিশালী করে এগিয়ে যান, আপনাদের সবাইকে আমি এই শুভকামনাই জানাই।

অনেক অনেক ধন্যবাদ।

***

 

 

CG/SB/SB/DM