নয়াদিল্লি, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২২
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মাননীয়া শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন ৫-৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ পর্যন্ত। ভারতে অবস্থানকালে শেখ হাসিনা ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মু এবং উপ-রাষ্ট্রপতি শ্রী জগদীপ ধনকরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভারতের বিদেশ মন্ত্রী ডঃ এস জয়শঙ্কর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী শ্রী জি কিষাণ রেড্ডি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর যে সমস্ত জওয়ান শহীদ হয়েছিলেন এবং যাঁরা গুরুতরভাবে জখম হয়েছিলেন, তাঁদের সন্তান-সন্ততিদের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ছাত্র বৃত্তি’র সূচনা ছিল শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে অন্যতম একটি বিশেষ কর্মসূচি। ৭ সেপ্টেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলি আয়োজিত এক বাণিজ্যিক বৈঠকেও ভাষণ দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী ৬ সেপ্টেম্বর এক একান্ত সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। পরে, দু’দেশের মধ্যে প্রতিনিধি পর্যায়েও আলাপ-আলোচনা চলে। এক হৃদ্য ও আন্তরিক পরিবেশে এই সাক্ষাৎকার ও বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। দু’দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, গণতান্ত্রিক মূল্য এবং বহুত্ববাদের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এক গভীর সম্পর্কের কথা উঠে আসে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সাক্ষাৎকারকালে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও অংশীদারিত্বের মধ্য দিয়ে দুটি দেশের মধ্যে যে কৌশলগত সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, সেই প্রসঙ্গে বিশেষ সন্তোষও প্রকাশ করেন দুই নেতা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ সফর করেন ২০২১-এর মার্চ মাসে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণই ছিল শ্রী মোদীর বাংলাদেশ সফরের মূল উদ্দেশ্য। দুটি দেশ আবার একইসঙ্গে দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানও উদযাপন করে। সম্মানিত অতিথি হিসেবে শ্রী মোদী বাংলাদেশের বিজয় দিবস-এর সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানেও যোগ দেন।
দু’দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফর বিনিময়ের মধ্য দিয়ে সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্র প্রসারিত হওয়ায় দুই প্রধানমন্ত্রীই বিশেষ সন্তোষ প্রকাশ করেন। এ বছর জুন মাসে ভারত ও বাংলাদেশের বিদেশ মন্ত্রীদের নেতৃত্বে যৌথ পরামর্শদান সম্পর্কিত কমিশনের সপ্তম বৈঠক নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়। এই বিষয়টিরও স্মৃতিচারণ করেন দুই নেতা।
নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ও যোগাযোগ, জলসম্পদ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহযোগিতা, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক মতবিনিময় সহ দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সবক’টি বিষয় নিয়েই দুই প্রধানমন্ত্রী কথাবার্তা বলেন। এছাড়াও, পরিবেশ সুরক্ষা, জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলা, সাইবার নিরাপত্তা, মহাকাশ প্রযুক্তি, সবুজ জ্বালানি, নীল অর্থনীতি সহ সহযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলিও স্থান পায় তাঁদের আলোচ্যসূচিতে।
বিভিন্ন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ও দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর আলোচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। কোভিড-১৯ অতিমারীজনিত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়ার বিষয়টি নিয়েও তাঁরা আলোচনা করেন। এই ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলায় এই অঞ্চলের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে মৈত্রী সম্পর্কের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর তাঁরা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
দু’দেশের মধ্যে রেল, সড়ক এবং অন্যান্য সংযোগ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসারে বিভিন্ন কর্মসূচি রূপায়ণের আশু প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেন দুই প্রধানমন্ত্রী। টোঙ্গি-আখাউরা রেলপথের প্রসার ও সম্প্রসারণ, বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশের রেল ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও সেই সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান ইত্যাদি ক্ষেত্রে দুটি দেশের মধ্যে যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে তাকে স্বাগত জানান শেখ হাসিনা এবং শ্রী নরেন্দ্র মোদী। হিলি-র সঙ্গে বিরামপুর-এর যোগাযোগ স্থাপন, বেনাপোল-যশোর রেলপথ বরাবর রেলের সিগন্যাল ব্যবস্থাকে উন্নত করে তোলা, বুড়িমারী ও চ্যাংরাবান্ধার মধ্যে সংযোগ ও যোগাযোগের পুনরুদ্ধার, সিরাজগঞ্জে একটি কন্টেনার ডিপো স্থাপন এবং কাউনিয়া-লালমণির হাট-মোঘলঘাট-নিউ গীতালদহ-র মধ্যে যোগাযোগ গড়ে তোলা ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়েও আলোচনা হয় তাঁদের মধ্যে। দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগিতার আওতায় এই প্রকল্পগুলির ব্যয়ভার বহনের বিষয়েও সহমত পোষণ করেন দুই নেতা। ব্রডগেজে ট্রেন চলাচলের জন্য বাংলাদেশকে ভারত ২০টি ডিজেল ইঞ্জিন দিয়ে সাহায্য করায় ভারতের বিশেষ প্রশংসাও করেন শেখ হাসিনা।
বর্তমানে ভারত হল বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের এক বৃহত্তম কেন্দ্র। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের এই উন্নয়ন প্রচেষ্টায় দুই নেতাই সন্তোষ প্রকাশ করেন। ভারত থেকে চাল, গম, চিনি, পেঁয়াজ, আদা ও রসুনের মতো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বাংলাদেশকে যোগান দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনা অনুরোধ জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে। শ্রী মোদী তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে সব রকম পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ রক্ষার বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে ভাবনাচিন্তা করা হবে।
দুই নেতাই স্বীকার করেন যে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলে শান্তি রক্ষার বিষয়টি যে একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত ক্ষেত্র, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। জিরো লাইনের ১৫০ গজের মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পের যে সমস্ত কাজ এখনও বাকি রয়েছে, তা দ্রুত সম্পূর্ণ করার জন্য দু’দেশের সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের নির্দেশ দেন তাঁরা। ত্রিপুরা সীমান্ত অঞ্চলে বেড়া দেওয়ার কাজও রয়েছে এই কর্মসূচির মধ্যে। শান্তিপূর্ণ ও অপরাধমুক্ত সীমান্ত অঞ্চল গড়ে তোলার ওপর দুই প্রধানমন্ত্রীই বিশেষ জোর দেন।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অপ্রীতিকর ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ায় দুই নেতাই সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন যে এক্ষেত্রে মৃত্যুর হারকে শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য জোরকদমে কাজ করে যাওয়া উচিৎ। দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় অস্ত্রের চোরাচালান, মাদক পাচার, জাল নোটের রমরমা এবং অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীরা যেভাবে তৎপরতা দেখিয়েছেন, তার বিশেষ প্রশংসাও করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। সন্ত্রাসকে নির্মূল করতে দুটি দেশই যে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ, একথাও পুনর্ব্যক্ত করেন শেখ হাসিনা ও শ্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁরা বলেন যে সন্ত্রাস ও উগ্রপন্থার মোকাবিলায় সমস্ত রকমভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হবে।
ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের মন্ত্রী পর্যায়ের ৩৮তম বৈঠকটি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় গত ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট, ২০২২ পর্যন্ত। ভারতের জলশক্তি মন্ত্রক এবং বাংলাদেশের জলসম্পদ মন্ত্রকের মধ্যে স্বাক্ষরিত মউটিকে স্বাগত জানান দুই প্রধানমন্ত্রী। এই মউ স্বাক্ষরের ফলে বাংলাদেশের জলসেচের চাহিদা যেমন পূরণ হবে, অন্যদিকে তেমনই দক্ষিণ আসামের জল প্রকল্পগুলির রূপায়ণও নিশ্চিত করা যাবে।
ত্রিপুরার জলসেচ সম্পর্কিত জরুরি প্রয়োজন মেটাতে ফেনী নদীর জল ভাগ করে নেওয়ার জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি দ্রুত সম্পাদন করার বিষয়টি সম্পর্কে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানানো হয় ভারতের পক্ষ থেকে। বাংলাদেশ ভারতের এই অনুরোধ রক্ষার জন্য বিশেষভাবে চিন্তাভাবনা করবে বলে জানানো হয়। জল সম্পর্কিত যে মউটি দু’দেশের মধ্যে ২০১৯ সালে স্বাক্ষরিত হয় তার রূপায়ণের মধ্য দিয়ে ফেনী নদীর ১.৮২ কিউসেক জল ত্রিপুরার সাব্রুম শহরে পানীয় জল সরবরাহের কাজে ব্যবহারের জন্য ভারতকে প্রয়োজনীয় কাজ শুরুর অনুমতি দেওয়ায় বাংলাদেশকে এ দেশের পক্ষ থেকে বিশেষ ধন্যবাদ জানানো হয়।
দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জল ব্যবস্থাপনার বিষয়টি যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, একথা স্বীকার করেন দুই প্রধানমন্ত্রীই। নদী সম্পর্কে দু’দেশের মধ্যে তথ্য ও পরিসংখ্যান বিনিময়ের জন্য যৌথ নদী কমিশন যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তাকে স্বাগত জানান শেখ হাসিনা এবং শ্রী নরেন্দ্র মোদী। দু’দেশের মধ্যে জল ভাগ করে নেওয়ার জন্য চুক্তি সম্পাদনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় খসড়া তৈরির কাজে এই তথ্য ও পরিসংখ্যান বিনিময় বিশেষভাবে সাহায্য করবে বলে তাঁরা মনে করেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার জল ভাগ করে নেওয়ার জন্য যে সমঝোতাপত্রটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার আওতায় বাংলাদেশ কতটা জল এ পর্যন্ত ব্যবহার করেছে সে সম্পর্কে সমীক্ষা চালানোর জন্য একটি যৌথ কারিগরি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান দুই প্রধানমন্ত্রী।
তিস্তার জলবন্টন সম্পর্কে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুরোধ জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। এ সম্পর্কিত একটি খসড়া প্রস্তুত করা হয় ২০১১ সালে। তিস্তার জলবন্টন সম্পর্কে আগের আলোচনার সূত্র ধরেই শেখ হাসিনা ভারতকে অনুরোধ জানান বিষয়টি বিবেচনার জন্য। দু’দেশের মধ্যে বয়ে চলা সাধারণ নদীগুলির নাব্যতা বৃদ্ধি ও দূষণ রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের নির্দেশ দেন দুই প্রধানমন্ত্রী।
আঞ্চলিক পর্যায়ে ভারত ও বাংলাদেশের পাওয়ার গ্রিডগুলির মধ্যে সংযোগ গড়ে তোলার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার ওপর জোর দেন দুই নেতাই। বিহারের কাটিহার থেকে আসামের বোড়নগর পর্যন্ত ৭৬৫ কেভি বিদ্যুৎ সংবহন লাইনটি বাংলাদেশের পার্বতীপুরের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়ার যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, সে সম্পর্কিত প্রকল্পের কাজও দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। অন্যদিকে, ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশের প্রস্তাবটি খতিয়ে দেখতে ভারতকে অনুরোধ করেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন বসানোর কাজে অগ্রগতির বিষয়টি পর্যালোচনা করেন দুই নেতা। তাঁরা আশা প্রকাশ করেন যে প্রকল্পটির কাজ অনতিবিলম্বেই সম্পূর্ণ হবে। বাংলাদেশের পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের চাহিদা পূরণে সহযোগিতা করার জন্য ভারতের কাছে আবেদন জানান শেখ হাসিনা। এ সম্পর্কে আলাপ-আলোচনার বাতাবরণ তৈরির কাজ শুরু করতে ভারত তার সম্মতির কথা জ্ঞাপন করে। আসাম ও মেঘালয়ে বন্যা বিপর্যয়ের কারণে আসাম থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ত্রিপুরায় পেট্রোলিয়াম, তেল ও লুব্রিক্যান্ট নিয়ে আসার কাজে ভারতকে সহযোগিতা করার জন্য শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে শোধিত পেট্রোলিয়াম সরবরাহের জন্য একটি নথিভুক্ত ‘জি-টু-জি’ সরবরাহকারী সংস্থা হিসেবে ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনকে বেছে নেওয়ায় ভারত ধন্যবাদ জানায় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে।
উন্নয়ন প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে বিশেষ অংশীদারিত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তার মধ্য দিয়ে সহযোগিতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় দুই নেতাই সন্তোষ প্রকাশ করেন। ভারত যেভাবে দক্ষতার সঙ্গে উন্নয়ন তহবিলের অর্থ বাংলাদেশকে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে, তার বিশেষ প্রশংসা করেন শেখ হাসিনা। তিনি স্বীকার করেন যে বাংলাদেশের উন্নয়নের কাজে ভারতই হল প্রধান সহযোগী রাষ্ট্র।
চট্টগ্রাম ও মঙ্গলা বন্দরকে ব্যবহারের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে জাহাজ চলাচলের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন দুই নেতাই। দুটি বন্দরের মধ্যে জাহাজ চলাচল অচিরেই পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে বলে তাঁরা মনে করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে ত্রিপুরার যোগাযোগ সহজতর করে তুলতে ফেনী নদীর ওপর মৈত্রী সেতু চালু করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোগত কাজ দ্রুত সম্পূর্ণ করার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানানো হয় ভারতের পক্ষ থেকে।
বিবিআইএন মোটর ভেহিকেল চুক্তি রূপায়ণের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক তথা আঞ্চলিক সংযোগ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুত চালু করতে সম্মত হন দুই নেতাই। পশ্চিমবঙ্গের হিলি থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মেঘালয়ের মহেন্দ্রগঞ্জ পর্যন্ত একটি সড়ক সংযোগ গড়ে তোলা সহ দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ের বিভিন্ন প্রকল্প যাতে দ্রুত রূপায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে অনুরোধ জানানো হয় ভারতের পক্ষ থেকে। ভারত-মায়ানমার-থাইল্যান্ড-এর মধ্যে যে ত্রিপক্ষীয় সড়ক প্রকল্প রূপায়ণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে বাংলাদেশ।
ভারত ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে তৃতীয় দেশগুলিতে পণ্য পরিবহণের জন্য ভারত বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশের বাণিজ্য গোষ্ঠীগুলিকে এজন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তার বন্দর কাঠামো ব্যবহার জন্য। নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারত ভূখণ্ড বাংলাদেশের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে, চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রুটে ভুটান পর্যন্ত রেল সংযোগ গড়ে তোলার কাজে সাহায্য করার জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রুটটির সদ্য উদ্বোধন হয়েছে। বাংলাদেশের এই অনুরোধ ভারত ভেবে দেখবে বলে জানিয়েছে। সীমান্ত বরাবর রেল সংযোগ গড়ে তুলতে বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে সমস্ত বিধিনিষেধ রয়েছে তা শিথিল করার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ জানানো হয়েছে ভারতের পক্ষ থেকে।
দু’দেশের উদ্যোগে একটি যৌথ সমীক্ষা চালানো হয় সুসংবদ্ধ অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রসারের লক্ষ্যে। সমীক্ষায় সুপারিশ করা হয়েছে যে এ সম্পর্কিত চুক্তিটি দু’দেশেরই প্রভূত উপকারে আসবে।
দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক প্রসারের ওপর জোর দিয়ে বলা হয়েছে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোগুলিকে আরও উন্নত করে তোলার জন্য বিশেষত, ল্যান্ড কাস্টমস স্টেশন ও ল্যান্ড পোর্ট অঞ্চলে আরোপিত বিধি-নিষেধ এজন্য শিথিল করার প্রস্তাবও করা হয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির স্বার্থে এবং বিপণন ব্যবস্থাকে আরও সহজ করে তুলতে ক্ষেত্র বিশেষে এই সমস্ত বিধি-নিষেধ তুলে দেওয়ার জন্য। আগরতলা-আখাউরা-র মধ্য দিয়ে এই বিপণন ব্যবস্থার প্রসার ঘটানো যেতে পারে। পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্তে পণ্য চলাচলের জন্য একটি দ্বিতীয় গেট তৈরির যে প্রস্তাব ভারত দিয়েছে, দুটি দেশের পক্ষ থেকে তার অগ্রগতি খতিয়ে দেখে দ্রুত এই কাজ সম্পূর্ণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে দু’দেশের সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের।
ভারত-বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে আরও গভীর ও মজবুত করে তোলার জন্য যে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে তাতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন দুই নেতাই। লাইন অফ ক্রেডিট-এর আওতায় সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলি দ্রুত চূড়ান্ত করার অনুকূলেও তাঁরা মত প্রকাশ করেন। বলা হয় যে এই প্রকল্পগুলি রূপায়িত হলে লাভবান হবে দুটি দেশই। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্য যান সংগ্রহের প্রস্তাবটি চূড়ান্ত হওয়ায় এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানানো হয়। নৌ-নিরাপত্তাকে আরও জোরদার করে তুলতে উপকূল বরাবর একটি রেডার সিস্টেম গড়ে তোলার যে প্রস্তাব ২০১৯-এ স্বাক্ষরিত মউটিতে করা হয়েছিল, তা দ্রুত রূপায়ণের কথা বলা হয় ভারতের পক্ষ থেকে।
কোভিড-১৯ অতিমারীকালে ভারত ও বাংলাদেশ পরস্পরের সঙ্গে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছে। ভারত থেকে ঐ সময় ‘ভ্যাক্সিন মৈত্রী’ এবং ‘অক্সিজেন এক্সপ্রেস’ ট্রেন বাংলাদেশে পাঠানো হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতকে দেওয়া হয় প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র। এইভাবে দু’দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্পর্ককে গভীরতর করে তোলার ওপর জোর দেন দুই প্রধানমন্ত্রী। দু’দেশের মধ্যে রেল, সড়ক, বিমান ও জলপথে সংযোগ ও যোগাযোগ পুনরায় চালু হওয়ায় বিশেষ সন্তোষও প্রকাশ করা হয়। রেল ও সড়ক পথের চেকপোস্টগুলি পুনরায় চালু করার যে সিদ্ধান্ত ভারত গ্রহণ করেছে তাকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশ। কোভিড-১৯ অতিমারীর আগের অবস্থায় সবক’টি চেকপোস্টকে ফিরিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়। এ বছর জুন মাস থেকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘মিতালী এক্সপ্রেস’ নামে একটি ট্রেন নিয়মিত যাত্রা শুরু করেছে। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয় দুই রাষ্ট্রনেতার পক্ষ থেকে।
ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম প্রযোজনায় বঙ্গবন্ধুর ওপর যে তথ্যচিত্রটি (মুজিব : দ্য মেকিং অফ আ নেশন) নির্মিত হয়েছে, তা দ্রুত রিলিজের ব্যাপারে আশাবাদী দুই প্রধানমন্ত্রীই। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের ওপর একটি তথ্যচিত্র প্রযোজনার জন্য একসঙ্গে কাজ করে যাওয়ার সপক্ষে মতপ্রকাশ করে দুটি দেশই। এছাড়াও, বাংলাদেশের মুজিব নগর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা পর্যন্ত ‘স্বাধীনতা সড়ক’ চালু করার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার কাজ যাতে অনতিবিলম্বেই সম্পূর্ণ হয় সে সম্পর্কেও আগ্রহ প্রকাশ করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭১-এর বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের ওপর বিরল ও দুষ্প্রাপ্য ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ ও সংকলন করার জন্য যৌথভাবে কাজ করার প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু অধ্যাপকের পদ সৃষ্টি হওয়ায় ভারতের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশ থেকে একটি স্টার্ট-আপ প্রতিনিধিদল ভারত সফরে আসবে। এর ফলে, উদ্ভাবন প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে দুটি দেশই মনে করে। আগামী মাসগুলিতে দু’দেশের মধ্যে পুনরায় চালু হবে যুব সফর বিনিময় কর্মসূচি। বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধাদের চিকিৎসার যে বন্দোবস্ত ভারতে করা হয়েছে, তার বিশেষ প্রশংসা করেন শেখ হাসিনা।
সুন্দরবন সংরক্ষণে ২০১১ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি মউ স্বাক্ষরিত হয়। এর সফল বাস্তবায়নের ওপর বিশেষ জোর দেন দুই প্রধানমন্ত্রী। তাঁরা বলেন যে সুন্দরবন সংরক্ষণের মাধ্যমে সেখানকার অরণ্য পরিবেশ সুরক্ষিত থাকবে এবং জীবন ও জীবিকার জন্য সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল স্থানীয় অধিবাসীরা তাতে বিশেষভাবে উপকৃত হবেন।
নতুন নতুন ক্ষেত্রগুলিতে দু’দেশের সহযোগিতার মাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে দুই নেতাই বলেন যে বহির্মহাকাশ, সবুজ জ্বালানি, পরমাণু অস্ত্রের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থ সংক্রান্ত বিষয়ে প্রযুক্তির প্রয়োগ সম্ভব করে তুলতে দুটি দেশই পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করে যাবে।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে আলোচনাকালে মায়ানমারের রাখাইন থেকে বিতাড়িত ১০ লক্ষেরও বেশি শরণার্থীকে মানবতার খাতিরে বাংলাদেশ যেভাবে আশ্রয়দানের মানসিকতা দেখিয়েছে তার বিশেষ প্রশংসা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ভারত হল বাংলাদেশ ও মায়ানমার – দুটি রাষ্ট্রেরই নিকটতম প্রতিবেশী। তাই, দুটি দেশকে সহায়তা করতে ভারত প্রস্তুত। যে শরণার্থীদের জোর করে তাঁদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, তাঁরা যাতে নিরাপদে আবার সেখানে ফিরে যেতে পারেন তা নিশ্চিত করতে দুটি দেশের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় সমর্থন যুগিয়ে যাবে ভারত।
আঞ্চলিক স্তরের বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার এক সুসংবদ্ধ বাতাবরণ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন শ্রী নরেন্দ্র মোদী ও শেখ হাসিনা। বিমস্টেক সচিবালয় গঠন এবং সে সম্পর্কিত পরিকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবদানেরও বিশেষ প্রশংসা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে দু’দেশের মধ্যে সহযোগিতা সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি মউ স্বাক্ষরিত হয়। রেল, সড়ক, নদী, তথ্যপ্রযুক্তি, বৈজ্ঞানিক ও শিল্প সংক্রান্ত গবেষণা, মহাকাশ প্রযুক্তি, সম্প্রচার, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা প্রসারের লক্ষ্যেই এই মউগুলি স্বাক্ষরিত হয়। এছাড়াও, কয়েকটি প্রকল্প ও কর্মসূচির উদ্বোধন ও ঘোষণাও ছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচির অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে রয়েছে :
*বাংলাদেশের রামপালে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিট-১-এর সূচনা
*রূপসা রেল সেতুর উদ্বোধন
*খুলনা-দর্শনা রেলপথ এবং পার্বতীপুর-কাউনিয়া রেলপথ সম্পর্কিত প্রকল্প ও কর্মসূচির ব্যবস্থাপনা ও চুক্তি সম্পর্কিত ঘোষণা
*বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ‘৭ মার্চের ভাষণ’-এর ২৩টি ভারতীয় এবং পাঁচটি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ সম্বলিত একটি বইয়ের উপস্থাপনা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বইটি তুলে দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর হাতে
*বাংলাদেশ রেলকে ভারতের পক্ষ থেকে ২০টি ডিজেল ইঞ্জিন উপহার
*বাংলাদেশের সড়ক ও মহাসড়ক দপ্তরকে সড়ক নির্মাণের যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ সরবরাহ সম্পর্কিত ঘোষণা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভারত সফরকালে ভারতের সরকার এবং জনসাধারণের কাছ থেকে যে উদার আতিথেয়তা ও আন্তরিকতা লাভ করেছেন, সেজন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীকে ধন্যবাদ জানান। বাংলাদেশ সফরের জন্য তিনি আন্তরিক আমন্ত্রণ জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে। ভবিষ্যতে আলাপ-আলোচনার সবক’টি মঞ্চে দু’দেশের মধ্যে পুনরায় মতবিনিময়ের সুযোগ আসবে এই আশা পোষণ করে যৌথ বিবৃতিটি শেষ হয়।
PG/SKD/DM