কেরলের দুই বিশিষ্ট সাধকী কুরিয়াকোসে ইলিয়াস শাভারা ও ইউফ্রেশিয়া সন্ত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য জাতীয় স্তরে যে অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে তাতে অংশ নিতে পেরে আমি আনন্দিত। এঁদের আগে সাধকী আলফান্সো সন্ত পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, যিনিও কেরলের বাসিন্দা। সন্ত শাভারা ও সন্ত ইউফ্রেশিয়ার জীবন ও কর্ম কেবলমাত্র খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের কাছেই নয়, বরং সামগ্রিকভাবে মানবজাতির কাছেও অনুপ্রেরণামূলক। নিঃস্বার্থ সেবার মাধ্যমে মানবজাতির কল্যাণের জন্য ঈশ্বরের কাছে নিজেদের উৎসর্গের দিক থেকে এঁরা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সন্ত শাভারা ছিলেন প্রার্থনায় বিশ্বাসী এবং একজন সমাজ সংস্কারক। শিক্ষার সুবিধা ছিল সীমিত এমন একটি যুগে তিনি প্রতিটি গীর্জায় একটি করে বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছিলেন। এইভাবে তিনি সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের জন্য শিক্ষার দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। কেরলের বাইরে অতি অল্প সংখ্যক মানুষই এ বিষয়ে অবগত আছেন যে, সন্ত শাভারা একটি সংস্কৃত শিক্ষার বিদ্যালয় ও একটি মুদ্রণ প্রেস চালু করেছিলেন। মহিলাদের ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। সন্ত ইউফ্রেশিয়া ছিলেন একজন সুফি ভাবধারার ব্যক্তিত্ব যিনি ঈশ্বরের কাছে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মানবজাতির সেবার মাধ্যমে এঁরা দু`জনেই নিজেদের জীবন ঈশ্বরের কাছে সমর্পণ করেছিলেন। বন্ধুগণ, আধ্যাত্মবাদ ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত। হাজার হাজার বছর আগে ভারতীয় সাধু ও গ্রীসের পরম বিজ্ঞ ব্যক্তিরা নিজেদের মধ্যে মেধা ও আধ্যাত্মিকতা বিনিময় করতেন। নতুন ধ্যান-ধারণার প্রতি ভারতের উদারতা ঋগ্বেদে স্পষ্ট প্রতীয়মান। এই দার্শনিকতা স্মরণাতীতকাল আমাদের মেধাবী ধ্যান-ধারণাকে সঠিক দিশায় পরিচালিত করেছে। ভারতমাতা বহু ধার্মিক ও আধ্যাত্মিক ধারার জন্ম দিয়েছে। ধার্মিক ও আধ্যাত্মিকতার এই ধারা ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে কখনও কখনও অন্যত্রও পৌঁছে গেছে। স্বাগত, শ্রদ্ধা ও সকল সত্যকে সম্মান জানানোর পরম্পরা ভারতের মতোই প্রাচীন। স্বামী বিবেকানন্দ যেমন বলেছিলেন, “আমরা কেবলমাত্র বিশ্ব সহনশীলতাতেই বিশ্বাস করি না, বরং আমরা সকল ধর্মকেই প্রকৃত হিসেবে স্বীকার করি।” গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন একটি ভূ-খণ্ডের স্বপ্ন দেখতে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন যেখানে মনে কোনও ভয় থাকবে না এবং মাথা থাকবে উঁচুতে। স্বাধীনতার এই স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলতে ও তার রক্ষা করতে আমরা দায়বদ্ধ। প্রতিটি ধর্মই সত্য, আমরা এ কথা বিশ্বাস করি। বন্ধুগণ, সমসায়মিক বিশ্বে শান্তি ও সম্প্রীতির জন্য যেটি মূল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সে প্রসঙ্গ আমি উত্থান করছি। ধর্মের দিক থেকে সমগ্র বিশ্বেই ক্রমবর্ধমান বিভেদ ও প্রতিকূলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষিতে সমস্ত সত্যের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রদর্শনের প্রাচীন ভারতীয় রীতিনীতি বিশ্ব আলোচনার অন্যতম বিষয় হয়ে উঠছে। বিশ্বের প্রতিটি প্রধান ধর্মের ধর্মগুরুরা নিজেদের আলোচনায় মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা এবং ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা প্রসারে শপথ নিয়েছেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘ তার ঐতিহাসিক মানবাধিকারের ঘোষণাপত্রে বিশ্বাসের প্রতি স্বাধীনতার বিষয়টিকে ব্যাখা করে কিভাবে এর স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা যায় তা বলেছে। আমরা স্বাধীনতার বিষয়টিকে একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত পছন্দ হিসেবে গণ্য করি। ভারত এবং আমার সরকার প্রসঙ্গে আমি ঘোষণা করছি যে, আমার সরকার রাষ্ট্রসঙ্ঘ মানাধিকার ঘোষণাপত্রের প্রতিটি অক্ষর মেনে চলবে। বিশ্বাসের প্রতি পূর্ণ স্বাধীনতার বিষয়টিকে আমার সরকার সুনিশ্চিত করবে এবং প্রত্যেকের নিজস্ব ধর্ম গ্রহণ ও তা মেনে চলার প্রকৃত অধিকার রয়েছে। আমার সরকার সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘু কোনও ধার্মিক গোষ্ঠীকেই অন্যের বিরুদ্ধে ঘৃণার মনোভাব প্রদর্শনকে বরদাস্ত করবে না। আমার সরকার সকল ধর্মকেই সমান শ্রদ্ধা দিয়ে থাকে। বুদ্ধ ও গান্ধীর দেশ ভারত। প্রত্যেক ভারতীয়র ডি.এন.এ. (কোষ)-তে প্রত্যেক ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা থাকা উচিত। কোনও ধর্মের বিরুদ্ধেই হিংসাকে আমরা বরদাস্ত করতে পারি না এবং এ ধরণের ঘটনা আমি কড়া ভাষায় নিন্দা করি। এই অঙ্গিকারের সঙ্গে আমি সমস্ত ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে সংযম, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে কাজ করার আবেদন জানাই। বন্ধুগণ, আধুনিক ভারত গড়ে তুলতে আমার একটি স্বপ্ন রয়েছে। এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে আমি একটি ব্যাপক অভিযানের সূচনা করেছি। আমার মূল মন্ত্র হল, উন্নয়ন – সকলের সঙ্গে সকলের বিকাশ। সহজ কথায় এর মানে হল প্রত্যেকের জন্য খাবার, প্রতিটি শিশু বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায়, প্রত্যেকের জন্য কাজ, প্রতিটি বাড়িতে শৌচাগার এবং প্রতিটি পরিবারে বিদ্যুৎ সংযোগ। এগুলিই ভারতকে গর্বিত করে তুলবে। একতার মধ্য দিয়ে এগুলি আমরা অর্জন করতে পারি। একতা আমাদের শক্তিশালী করে। বিভেদ আমাদের দুর্বল করে দেয়। বিপুল এই কর্মযজ্ঞে আমাকে সহায়তা করার জন্য সকল ভারতীয়কে এবং এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলকে আমি আন্তরিক অনুরোধ জানাই। সন্ত শাভারা ও সন্ত ইউফ্রেশিয়ার সন্ত পর্যায়ে উত্তরণ এবং এঁদের মহান কৃতিত্ব আমদের অন্তরের শক্তি বৃদ্ধি করুক, নিঃস্বার্থ সেবার মধ্য দিয়ে সমাজের পরিবর্তনের জন্য এই শক্তিকে কাজে লাগাই এবং একটি উন্নত ও আধুনিক ভারতের সমবেত স্বপ্নকে পূর্ণ করি।