Search

পিএমইন্ডিয়াপিএমইন্ডিয়া

সাম্প্রতিক সংবাদ

বিষয়টিকে সরাসরি পিআইবি থেকে নেওয়া হয়েছে

ইউনেস্কো’তে প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর ভাষণের বয়ান


নয়াদিল্লি, ১১ এপ্রিল, ২০১৫ ডিরেক্টর জেনারেল ম্যাডাম বুকোভা, মহামান্য ভদ্রমণ্ডলী, ইউনেস্কোতে আজ বক্তব্য পেশের সুযোগ পেয়ে আমি সত্যিই নিজেকে সম্মানিত বোধ করছি। এই বিশেষ প্রতিষ্ঠানটির ৭০তম বার্ষিকীতে এখানে আসতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করছি। মানব ইতিহাসে সারা পৃথিবীর কল্যাণের জন্য রাষ্ট্রসঙ্ঘের মতো একটি প্রতিষ্ঠান আমরা পেয়েছি। এটি নিঃসন্দেহে বর্তমান যুগে আমাদের একটি মৌলিক সাফল্যের স্মারক হয়ে থাকবে। বহু দশক ধরে বর্তমান বিশ্বে বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে এবং বহু অগ্রগতির সাক্ষ্য বহন করে এই প্রতিষ্ঠানটি নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়ে আজও নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। অনেক বিষয়েই মানুষের দ্বিধা ও সংশয় থাকতে পারে। তা দূর করাও বিশেষভাবে জরুরি। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সূচনাকাল থেকেই বহু জাতি এখানে মিলিত হয়েছে এবং পরবর্তীকালে আরও তিনগুণ বেশি দেশ রাষ্ট্রসঙ্ঘে যোগদান করেছে। তাই, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, রাষ্ট্রসঙ্ঘের জন্যই আমাদের বিশ্ব আজও বর্তমান এবং নিঃসন্দেহে অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে একটি সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এই বিশ্বাসই রাষ্ট্রসঙ্ঘের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের আওতায় আরও বহু সংস্থার জন্ম দিয়েছে, যা মানুষের চ্যালেঞ্জের বিভিন্ন দিক নিয়ে নিয়ত চিন্তাভাবনা করে। আমাদের সকলের সম্মিলিত লক্ষ্য হল, বিশ্বের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা যেখানে প্রতিটি জাতিরই থাকবে তার বক্তব্য পেশের অধিকার, সমস্ত মানুষের থাকবে স্বতন্ত্র পরিচয়, আর সমস্ত রকম সংস্কৃতি হয়ে উঠবে একই উদ্যানের এক একটি ফুল। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক মানুষেরই মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে, প্রত্যেক শিশুর রয়েছে সুযোগ ও সম্ভাবনাময় এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অধিকার। আর আমাদের পৃথিবী নামক এই গ্রহের রয়েছে তার সমস্ত গৌরব ও গরিমা অক্ষয় করে রাখার মতো অধিকার। এই বিশেষ প্রতিষ্ঠানটি ছাড়া আর কোনও সংস্থাই এর থেকে বেশি করে আমাদের স্বার্থ দেখভাল করতে পারে না। আমাদের সকলের অদৃষ্ট নিহিত রয়েছে মানুষের মানসিকতার মধ্যে, যা শিক্ষার আলো এবং জানার কৌতুহল থেকে আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। আর তা বিজ্ঞানের বিস্ময়কর ঘটনার হাত ধরে বয়ে আনে প্রগতি ও অগ্রগতি। এই সমস্ত শক্তির মূলে রয়েছে প্রকৃতির মূল ব্যঞ্জনা, বিবিধের মাঝেও ঐক্য ও সম্প্রীতির সমন্বয়। আর এই কারণেই, রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রথম লক্ষ্যই ছিল ইউনেস্কোর মতো একটি সংস্থা গঠন করা। ইউনেস্কোর কাজকর্মকে ভারত গভীরভাবে সম্মান জানিয়ে এসেছে এবং আমাদের পারস্পরিক অংশীদারিত্বকে আরও নিবিড় করে তুলতে চেয়েছে। ইউনেস্কোর সূচনাকাল থেকেই আমাদের সম্পর্কের অসামান্য গৌরবকে আমরা লালন করেছি। বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শিক্ষার আশু প্রয়োজনীয়তার কথা উপলব্ধি করে ইউনেস্কো’কে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। আমাদের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাধাকৃষ্ণণ এই প্রতিষ্ঠানটির সূচনার বছরগুলিতে এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভারতে শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রসারে এবং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণে ইউনেস্কোর ভূমিকার জন্য আমরা বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। একইভাবে সারা বিশ্বে এই লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে ইউনেস্কোর পাশে এসে দাঁড়ানোর সুযোগ আমাদের হয়েছে। ভারত যে সমস্ত সমস্যার মোকাবিলা করে এবং যে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে তা সমস্তই ইউনেস্কোর আদর্শকে অনুসরণ করে। এক সুপ্রাচীন ভূমিতে আমরা গড়ে তুলেছি এক আধুনিক রাষ্ট্র। আমাদের রয়েছে, সময়াতীত কালের উদার সহাবস্থানের এক ঐতিহ্য এবং আমাদের সমাজ গড়ে উঠেছে বহু বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি নাগরিক হাতে-হাত মিলিয়ে দেশকে করে তুলেছে শক্তিশালী এবং দুর্বলতম মানুষটির ক্ষমতায়নের মধ্য দিয়ে আমরা বিচার করবো আমাদের প্রকৃত অগ্রগতিকে। এক বছর আগে কার্যভার গ্রহণের পর থেকেই এই বিশ্বাসের প্রতি রয়েছে আমাদের অবিচল আস্থা। নিরুত্তাপ পরিসংখ্যান দিয়ে আমরা আমাদের প্রগতি ও অগ্রগতিকে বিচার করবো না। আমাদের বিচারের মাপকাঠি হবে প্রতিটি মানুষের মুখে ফুটে ওঠা আশা ও বিশ্বাস। আর তা হয়ে উঠবে নানা দিক থেকেই অর্থবহ। প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার ও স্বাধীনতাকে আমরা একদিকে যেমন রক্ষা করব অন্যদিকে তেমনই তা সুরক্ষিত রাখতেও আমাদের কর্মপ্রচেষ্টাকে নিয়োজিত করব। যে কোনও বিশ্বাস, ধর্ম ও সংস্কৃতির নাগরিকদের যাতে সমাজে সমান সুযোগ থাকে তা আমরা নিশ্চিত করবো। এই সমাজের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে আমাদের থাকবে অটুট বিশ্বাস এবং দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে আমরা এই কাজে এগিয়ে যাব। আমাদের ঐতিহ্যে শিক্ষা বরাবরই এক বিশেষ স্থান অধিকার করে এসেছে। আমাদের এক প্রাচীন উক্তি অনুযায়ী, বিদ্যা-সম্পদই সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ, জ্ঞানই হল মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি, দানেও যার ক্ষয় নেই। দেশের যুব সম্প্রদায়কে সুদক্ষ করে তুলতে আমরা এক উচ্চাকাঙ্খামূলক কর্মসূচির কাজে হাত দিয়েছি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি শিশুর জন্য আমরা গড়ে তুলেছি এক শিক্ষা ব্যবস্থা। দেশের মহিলারা যদি প্রতিদিন ভয়-ভীতির শিকার হয়ে পড়েন, সুযোগ ও সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ হয়ে থাকে তাদের সামনে তা হলে দেশের অগ্রগতি অধরাই থেকে যাবে। যেদিন তাঁরা যাবতীয় কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের বলি থেকে মুক্তি পাবেন, সেদিনই আসবে তাঁদের প্রকৃত মুক্তি। আর, আমাদের এই পরিবর্তন শুরু করতে হবে শিশুকন্যাদের দিয়ে। ভারতের শিশুকন্যাদের জন্য শিক্ষা ও সুযোগসুবিধার সম্প্রসারণ আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। তারা যাতে নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে স্কুলে যেতে পারে তা আমরা নিশ্চিত করব। আজকের দিনে ডিজিটাল ব্যবস্থা আমাদের সামনে যে সমস্ত সুযোগসুবিধা এনে দিয়েছে তা ছিল এক সময়ে অকল্পনীয়। কিন্তু, মনে রাখতে হবে এর সুযোগ সমানভাবে বন্টন না করা গেলে বৈষম্যের সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে, ডিজিটাল যোগাযোগ ও স্মার্ট ফোন শিক্ষা, পরিষেবা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা এনে দিয়েছে। বর্তমান যুগের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর পরিবর্তনের ঘটনা হল এটাই। ডিজিটাল ভারত এমন এক শাসন ব্যবস্থা তথা সরকার গড়ে উঠতে সাহায্য করবে যার সঙ্গে দেশের নাগরিকদের থাকবে নিবিড় যোগাযোগ। পারস্পরিক অংশীদারিত্ব, স্বচ্ছতা ও সংবেদনশীলতার মধ্য দিয়ে এই সরকার কাজ করে যাবে। দেশের ৬ লক্ষ গ্রামকে যুক্ত করতে আমরা ইতিমধ্যেই শুরু করেছি এক ডিজিটাল সাক্ষরতা মিশন। মনে রাখতে হবে, মানুষের বাসযোগ্য ভূমি ও তার অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার মধ্যে একটি গভীর ও দৃঢ় সংযোগ রক্ষা করা প্রয়োজন। আর এই লক্ষ্যেই, আমার সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি ক্ষেত্র হল, প্রতিটি মানুষের মাথার ওপর ছাদের ব্যবস্থা করা। প্রতিটি বাড়িতে থাকবে বিদ্যুৎ, পরিচ্ছন্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও নির্মল জল যার সুযোগ থেকে কেউই বঞ্চিত হবে না। প্রতিটি শিশুর থাকবে বেঁচে থাকার অধিকার এবং প্রত্যেক নতুন মায়ের থাকবে তাঁর সন্তানকে যত্ন ও দেখভাল করার অধিকার। আর এই সমস্তই আমাদের করতে হবে নদী ও বায়ুকে দূষণমুক্ত করে। প্রতিটি অরণ্যে শোনা যাবে পাখিদের কলকাকলি। আমাদের এই সমস্ত লক্ষ্য পূরণে শুধুমাত্র নীতি প্রণয়ন ও সহায়সম্পদের সংস্থানই যথেষ্ট নয়। তার থেকেও যা বেশি প্রয়োজন তা হল বিজ্ঞানের শক্তিকে কাজে লাগানো। বিজ্ঞান হল আমাদের কাছে মানুষের বিকাশের পথে এক সবচেয়ে বড় সুযোগ, যা এক নিরাপদ, নিরন্তর ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে। সীমান্তের গন্ডী পেরিয়ে বিজ্ঞান প্রতিটি দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে পারে। বিজ্ঞানের সুযোগসুবিধা থেকে যারা বঞ্চিত, তাদের কাছে এই সুফল পৌঁছে দিয়ে আমরা আমাদের পৃথিবীকে একটি উন্নততর বাসযোগ্য স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। অতীতে ভারত অনেকের কাছেই সাহায্য পেয়ে এসেছে। এই ঋণ আমরা কোনও দিনই ভুলতে পারবো না। আর বর্তমানে অন্যের উন্নয়ন ও বিকাশের প্রতি আমরা দায়িত্বশীল ও দায়বদ্ধ। তাই, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যোগাযোগ বাড়িয়ে তুলতে বিজ্ঞানকে একটি উপায় হিসেবে ভারত অগ্রাধিকারের স্থানে বসিয়েছে। অন্যদিকে, সংস্কৃতি হল মানুষের এক মহান আত্মপ্রকাশ, যা সমাজের ভিতকে আরও মজবুত করে তোলে। তাই, ভারত সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ইউনেস্কো যে ভূমিকা পালন করে চলেছে, তা আমাদের মধ্যে খুব উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার সঞ্চার করে। ভারতের যে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে তাকে আমরা মানবজাতির এক সম্পদ বিশেষ বলেই মনে করি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা আমাদের সাধ্যমতো তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবো। আমরা ঐতিহ্যের বিকাশ ও প্রসার যোজনা চালু করেছি, যার হিন্দিতে আমরা নাম দিয়েছি ‘হৃদয়’। আমদের বিভিন্ন শহরের যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে তা আমরা এর আওতায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবো। দেশের যে তীর্থ ক্ষেত্রগুলি রয়েছে, সেগুলিকে নতুন করে গড়ে তুলতে আমরা শুরু করেছি এক বিশেষ কর্মসূচি ‘প্রসাদ’। তীর্থস্থানগুলির পুনরুজ্জীবন এবং আধ্যাত্মিকতার বিকাশ অভিযান নামে এই কর্মসূচিটি পরিচিত। ম্যাডাম চেয়ারম্যান, আমরা আমাদের উদ্যোগ ও দৃষ্টিভঙ্গীর কথা বিশেষভাবে তুলে ধরছি, কারণ, আমাদের আশা-আকাঙ্খা ও কর্ম প্রচেষ্টার মধ্যে বর্তমান বিশ্বে ইউনেস্কোর কাজকর্মের বিষয়টিকে আমরা আরও ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারছি। বর্তমান বিশ্বে যে সমস্ত চ্যালেঞ্জের আমরা সম্মুখীন, তার মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্ব কতখানি তাও আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। বিভিন্ন দেশের সীমানার গন্ডী পেড়িয়ে বিভিন্ন শহর ও সমাজের মধ্যে মানুষের যোগাযোগ বেড়ে চলেছে। আর এর সঙ্গে শুরু হয়েছে রাষ্ট্রের আধিপত্যের পরিবর্তে বিভিন্ন গোষ্ঠীর ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম। তাই, আমাদের আজকের আন্দোলন, শুধুমাত্র আমাদের ইপ্সিত লক্ষ্যের জন্যই নয় বরং নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার তাগিদেও। শুধু তাই নয়, এই সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলেছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। মনে রাখতে হবে, মাউস ক্লিক করলেই যোগাযোগের দুনিয়ায় আমরা এখন প্রবেশ করতে পারি। তাই, আমরা এখন বাস করছি এক তথ্যের যুগে। আমরা জানি যে, সব কিছু জানলেই সৌভ্রাতৃত্বের প্রসার ঘটে না বা অন্ধ বিশ্বাস ও সংস্কারের অবসান ঘটে না। যখন ইবোলা একটি সমগ্র অঞ্চলকে গ্রাস করে, আকস্মিক ঘূর্ণিঝড় বহু জীবন ও শস্যহানি ঘটায় এবং ভয়ঙ্কর রোগব্যাধি আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টাকে বিফল করে দেয়, তখনই আমরা অনুভব করি, আমরা এখনও কত অসহায়। আজকের দিনে আমরা যখন দেখি বহু মানুষের জীবন বিপন্ন, শিক্ষা ক্ষেত্রে শিশুরা অন্যায় ও অবিচারের শিকার এবং পর্যাপ্ত মানবসম্পদের অভাবে বহু দেশের অগ্রগতির সম্ভাবনা ক্ষীণ তখনই আমরা উপলব্ধি করি যে, আমাদের এখনও অনেক কিছু করার বাকি। কিন্তু আমরা জানি, গত সাত দশক ধরে পৃথিবীর অগ্রগতি ঘটেছে অবিশ্বাস্যভাবে। আমাদের এই প্রগতি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে আমাদের মধ্যে উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা সঞ্চার করে। আর এই সমস্ত কাজে ইউনেস্কো এক বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ, সংস্কৃতি সমগ্র পৃথিবীকে খন্ডে খন্ডে বিভক্ত করে না বরং একত্রিত করে, ঐক্যবদ্ধ করে। তা হয়ে উঠতে পারে বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও বোঝাপড়ার বাতাবরণ গড়ে তোলার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এই আবহে বিভিন্ন জাতি শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে, এশিয়া ও ভারত মহাসাগরের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সংযোগ স্থাপন করে চলেছে, যাতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে মৈত্রীর মেলবন্ধন ঘটানো যায়। সমগ্র পৃথিবী জুড়ে সন্ত্রাসবাদ, হিংসা এবং বিচ্ছিন্নতার যে শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তাকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার প্রতি আমাদের আরও বেশি করে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে। আরও অর্থবহ বিশ্ব শান্তি গড়ে তুলতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে যুব কর্মসূচি বিনিময়ে আমাদের আরও বেশি করে জোর দিতে হবে। জ্ঞানের ঐতিহ্যের যে সম্পদ আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে তাকেও আমাদের লালন করতে হবে। যুগ যুগ ধরে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্ব সমাজ। আর তার মধ্যে নিহিত রয়েছে অর্থনৈতিক ও পরিবেশ-বান্ধব এক সুদক্ষ সমাধানসূত্র। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে এই জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বাতাবরণ আজ বিশেষভাবে বিপন্ন। তাই, ঐতিহ্যবাহী জ্ঞানসম্পদের পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে আমাদের আরও বেশি করে যত্নবান হতে হবে। এই কাজ সম্ভব হলে মানব সভ্যতা সম্পর্কে এক মৌলিক সত্যের নতুন সংজ্ঞা আমরা নির্ধারণ করতে পারব। কারণ, আমাদের সংস্কৃতি হল বৈচিত্র্যময় এবং আমাদের জ্ঞানের উৎস এক নয়, বহু। আর এই কাজ করতে হলে বহু নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। বিশ্বের কয়েকটি বিভিন্ন অংশে স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা সহ মানব-কল্যাণের বিভিন্ন দিকে অগ্রসর হতে বিজ্ঞানকে আমাদের হাতিয়ার করে তুলতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন সমগ্র বিশ্বের কাছেই এক ভয়ঙ্কর চ্যালেঞ্জ। তার মোকাবিলায় প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সমস্যার যথাযথ অনুধাবন। জ্ঞানের অফুরন্ত ভাণ্ডার প্রতিটি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সমবেত শক্তি, নতুন নতুন উদ্ভাবনের সম্ভাবনা এবং বিজ্ঞানের শক্তি। সমস্ত কিছুকে একত্রিত করে আমাদের এই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সুপ্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বাস ও প্রকৃতির মধ্যে এক গভীর সংযোগ রয়েছে বলে আমরা মনে করি। আমরা বিশ্বাস করি, সমৃদ্ধির একমাত্র পথ হল – তাকে সতত নিরন্তর রাখা। আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের স্বাভাবিক অনুশীলনের মধ্য দিয়েই আমরা এই বিষয়টিকে বেছে নিয়েছি। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যতের প্রতি এক অঙ্গীকারও আমাদের এই কাজে অনুপ্রাণিত করে। আগামী সাত বছরে দেশে ১৭৫০০০ মেগাওয়াট দূষণমুক্ত ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আমরা স্থির করেছি। অনেক সময়েই দূষণের মাত্রা কিভাবে হ্রাস করা যায়, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু, শুধুমাত্র কোনও কাজকে বেছে নিলেই হবে না, যে কোনও গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করার কাজেও আমাদের সফল হতে হবে। আর এই কারণেই, দূষণমুক্ত জ্বালানি উদ্ভাবনে এই পৃথিবীর প্রত্যেকটি জাতিকে একযোগে কাজ করার আহ্বান আমি জানিয়েছি। এই শক্তি তথা জ্বালানিতে প্রত্যেকেরই থাকবে সুলভ উত্তরাধিকার। এই একই কারণে, মানুষের জীবনশৈলীতে পরিবর্তন আনারও আমি পক্ষপাতী। আমরা কিভাবে জীবন ধারণ করবো, তার ওপরেই নির্ভর করবে দূষণের মাত্রা হ্রাস করার কাজে আমরা কতটা সফল হতে পারবো। আর এভাবেই মানব-কল্যাণে আমরা এক নতুন পথ খুঁজে পাওয়ার কাজে সফল হবো। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই গত সেপ্টেম্বর মাসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ২১ জুন তারিখটিকে আন্তর্জাতিক যোগ দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আমি আহ্বান জানিয়েছিলাম। কারণ যোগ ব্যায়াম একজন ব্যক্তি মানুষকে তার নিজের সঙ্গে যেমন একাত্ম হতে সাহায্য করে অন্যদিকে তেমনই, সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যেও একাত্মতা ও সম্প্রীতির সমন্বয় গড়ে তোলে। আমাদের জীবনশৈলীতে পরিবর্তন এবং চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে যোগ জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবিলার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব ভারসাম্য রক্ষার কাজেও সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। গত ডিসেম্বরে ইউ.এন.জি.এ. এই প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং অল্পকালের মধ্যেই তা অনেকের অনুমোদন লাভ করে। ভারতের পক্ষ থেকে এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র এক মৈত্রীসুলভ দৃষ্টিভঙ্গীকেই প্রতিফলিত করে না, আমাদের পরিচিত গন্ডীর বাইরে গিয়েও অনেকগুলি চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে আমাদের যে সম্মিলিত শক্তি রয়েছে তাও এর মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। গঙ্গার দূষণমুক্তির যে লক্ষ্য আমরা গ্রহণ করেছি, তা যেমন একদিকে সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, জ্ঞানের ঐতিহ্য, শিক্ষা অর্থনীতি তথা পরিবেশের মধ্যে সঙ্গতি ঘটায়, একই সঙ্গে জীবনশৈলী সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যেও পরিবর্তন নিয়ে আসে। ম্যাডাম চেয়ারপার্সন, প্রেক্ষাগৃহের বাইরে এক মহান ভারতীয় দার্শনিক ঋষি শ্রী অরবিন্দের প্রতিমূর্তির প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছি। তাঁর মানবতাবাদ ও আধ্যাত্মিকতা থেকে আমরা বহু শিক্ষা লাভ করেছি। বহির্বিশ্বের সঙ্গে ব্যক্তি চেতনার যোগসূত্র স্থাপনে ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস। শিক্ষার আলোকোজ্জ্বল ভূমিকা, বিজ্ঞানের দান, জাতীয় মুক্তি, বৈচিত্র্যময় সভ্যতা এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্য দিয়ে যে বিশ্ব অখন্ডতা গড়ে উঠতে পারে, তা আমরা তাঁর কাছ থেকেই শিক্ষালাভ করেছি। রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠানটির মূল অন্তর্নিহিত শক্তির মধ্যে রয়েছে মানুষের মনে শান্তি ও নিরাপত্তা গড়ে তোলার আশ্বাস। এই প্রতিষ্ঠানটি আজ পর্যন্ত যে সমস্ত উল্লেখযোগ্য কাজ করে এসেছে আজ তার ৭০তম বার্ষিকীর শুভক্ষণে আমরা তা স্মরণ করি। বহু সময় ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা যে জ্ঞান আহরণ করেছি তাকে সঙ্গে নিয়ে ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার এটি হল আমাদের কাছে বিশেষ একটি মুহূর্ত। রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আমরা যা করতে চেয়েছি ইউনেস্কোর ভূমিকা তার মধ্যে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে। নিরন্তর বিকাশ, ২০১৫ পরবর্তী কর্মসূচি, জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা শান্তি ও নিরাপত্তা যাই হোক না কেন এই কাজে তার কৃতিত্ব কোনও দিক দিয়েই কম নয়। ভবিষ্যতের প্রতি ইউনেস্কোর দায়িত্বশীলতা উত্তরোত্তর আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই, আমাদের অঙ্গীকারকে আরও দৃঢ় ও ঐকান্তিক করে তুলতে হবে। আমাকে এখানে বক্তব্য পেশের সুযোগ দেওয়ার জন্য আপনাদের সকলকে জানাই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।