শ্রী চন্দ্র শেখরের জন্ম ১৯২৭ সালের ১৭ এপ্রিল উত্তর প্রদেশের বালিয়া জেলার ইব্রাহিমপাত্তি গ্রামের এক কৃষক পরিবারে। জনতা দলের সভাপতি পদে তিনি আসীন ছিলেন ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত।
ছাত্র জীবনেই রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। এক বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ও মতবাদের ‘তরুণ তুর্কি’ হিসেবেই তিনি তখন খ্যাত ছিলেন। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫০-৫১) থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পঠনপাঠনের পর তিনি সমাজবাদী আন্দোলনে যোগ দেন। আচার্য নরেন্দ্র দেবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সুযোগ তাঁর হয়েছিল। পরে, বালিয়ার জেলা প্রজা সমাজবাদী পার্টির সম্পাদক পদে তিনি নির্বাচিত হন। এর এক বছরের মধ্যেই উত্তর প্রদেশের রাজ্য প্রজা সমাজবাদী পার্টির যুগ্ম সম্পাদক পদে তাঁর নির্বাচন। উত্তর প্রদেশ রাজ্য প্রজা সমাজবাদী পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব তিনি পালন করেন ১৯৫৫-৫৬ সালে।
১৯৬২ সালে উত্তর প্রদেশ থেকে তিনি রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। এরপর , ১৯৬৫ সালে তিনি যোগ দেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে। কংগ্রেস সংসদীয় দলের সাধারণ সম্পাদক পদে তিনি নির্বাচিত হন ১৯৬৭ সালে। সাংসদ হিসেবে তিনি দলিত ও অবহেলিতদের স্বার্থ রক্ষায় সরব হন এবং দ্রুত সামাজিক পরিবর্তনের পক্ষে জোর সওয়াল করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একচেটিয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের অসম বারবাড়ন্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ক্ষমতাসীন দলের বিরাগভাজন হন।
কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে তাঁর এই লড়াইয়ের জন্য তিনি ‘তরুণ তুর্কি’ হিসেবে পরিচিত হন। কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণায় তাঁর ছিল দৃঢ় মনোবল, আত্মবিশ্বাস, সাহস ও একনিষ্ঠা। ইয়াং ইন্ডিয়ান সাপ্তাহিক পত্রিকার তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। দিল্লি থেকে এই পত্রিকাটির প্রকাশ শুরু হয় ১৯৬৯ সালে। এর সম্পাদকীয়র কথা সেই সময় লোকের মুখে মুখে ফিরত। জরুরি অবস্থার সময় (১৯৭৫-এর জুন থেকে ১৯৭৭-এর মার্চ) পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু, ১৯৮৯-এর ফেব্রুয়ারি থেকে আবার তা নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। পত্রিকাটির সম্পাদনা উপদেষ্টা পর্ষদের তিনিই ছিলেন সভাপতি।
শ্রী চন্দ্র শেখর সারা জীবন ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির বিরোধিতা করে গেছেন। মতাদর্শ ও সামাজিক পরিবর্তনের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন। রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর এই চিন্তাভাবনাই তাঁকে শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের সান্নিধ্যে এনে দেয়। ১৯৭৩ -৭৫-এর অস্থির দিনগুলিতে জয়প্রকাশজির মতাদর্শগত রাজনীতি তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করেছিল। ফলে, অচিরেই তিনি কংগ্রেসের এক বিক্ষুব্ধ নেতা বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
১৯৭৫-এর ২৫ জুন দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই তিনি মিসায় (মেন্টেন্যান্স অফ ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট) গ্রেপ্তার হন যদিও তিনি সেই সময় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সর্বোচ্চ সংস্থা কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটি এবং কার্যনির্বাহী গোষ্ঠীর একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
ঐ সময় শাসক দলের যে কয়েকজন নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয় শ্রী চন্দ্র শেখর ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
ক্ষমতার রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সামাজিক পটপরিবর্তনের অঙ্গীকারের রাজনীতিকে তিনি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেন।
জরুরি অবস্থার সময় কারারুদ্ধ থাকাকালীন তিনি হিন্দিতে একটি রোজনামচা লিখতেন। পরে, ‘মেরি জেল ডায়েরি’ নামে তা প্রকাশিত হয়। তাঁর বিভিন্ন রচনার একটি সুপরিচিত সঙ্কলন গ্রন্থ হল ‘ডায়নামিক্স অফ সোশ্যল চেঞ্জ’।
১৯৮৩ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ঐ বছরেরই ২৫ জুন পর্যন্ত সুদূর দক্ষিণের কন্যাকুমারী থেকে নয়াদিল্লির রাজঘাট (মহাত্মা গান্ধীর সমাধিক্ষেত্র) পর্যন্ত ৪,২৬০ কিলোমিটার দূরত্ব তিনি অতিক্রম করেন
এক পদযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে আরও নিবিড় করে তুলতে এবং তাঁদের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতেই তিনি পদযাত্রার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
দেশের অনগ্রসর এলাকাগুলিতে সমাজ ও রাজনীতির কাজে যুক্ত মানুষদের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনদানে এবং তৃণমূল পর্যায়ে জনশিক্ষার প্রচারে তিনি কেরল, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ এবং হরিয়ানার বিভিন্ন প্রান্তে ১৫টির মতো ভারত যাত্রা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬২ থেকে তিনি ছিলেন সংসদ সদস্য। মাঝখানে ছেদ পড়েছিল ১৯৮৪ -৮৯ – এই সময়কালটুকু। ১৯৮৯ সালে তাঁর নিজের কেন্দ্র বালিয়া এবং সন্নিহিত বিহারের মহারাজগঞ্জ থেকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সামিল হয়ে দুটিতেই জয়ী হন। পরে, বিহারের আসনটি তিনি ছেড়ে দেন।
শ্রী চন্দ্র শেখর এবং শ্রীমতী দুজা দেবীর বিবাহিত জীবনে দুই সন্তানের জন্ম হয় – পঙ্কজ ও নীরজ।