২০১৮-র ১৮ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে-এর আমন্ত্রনে সেদেশের সরকারের অতিথি হিসাবে ব্রিটেন সফর করেন। দুই নেতা বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত ও গঠনমূলক আলোচনা করেন এবং আমাদের কৌশলগত অংশিদারিত্বের ওপর জোর দেন। এছাড়া আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুর বহু ক্ষেত্রে উভয় দেশের অবস্হানগত মিল নিয়েও তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। ২০১৮-র ১৯ এবং ২০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী মোদী কমনওয়েল্থ ভুক্ত রাষ্ট্রপ্রধানদের বৈঠকে অংশ নেবেন।
ভারত এবং ব্রিটেন তাদের কৌশলগত অংশিদারিত্বকে আরও শক্তিশালী করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। অভিন্ন মূল্যবোধ, সাধারণ আইন-কানুন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রাচীনতম ও বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে আছে এই অংশিদারিত্ব। আমরা কমনওয়েল্থ রাষ্ট্র জোটের দায়িত্বশীল সদস্য। আমরা এমন এক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গির অংশীদার যা শক্তি প্রয়োগ বা জোর করে এক তরফাভাবে নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্হাকে পরিবর্তনের বিরোধী। আমরা দুই দেশের মধ্যে অগনিত ব্যক্তিগত ও পেশাগত সম্পর্কের এক জীবন্ত সেতুর অংশীদার।
ভারত এবং ব্রিটেন অন্যান্য কমনওয়েল্থভুক্ত রাষ্ট্র, কমনওয়েল্থ সচিবালয় এবং অন্যান্য অংশীদার সংগঠনের সঙ্গে একযোগে বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলার লক্ষ্যে কাজ করবে। আমরা কমনওয়েল্থকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলার জন্য দায়বদ্ধ। বিশেষ করে ক্ষুদ্র এবং দুর্বল রাষ্ট্রগুলির কাছে ও আমাদের যুব সমাজের কাছে এর প্রাসঙ্গিকতা সুনিশ্চিত করতে চাই। এই যুব সমাজই কমনওয়েল্থভুক্ত দেশগুলির জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের কাছাকাছি। কমনওয়েল্থ রাষ্ট্রজোটের বৈঠক এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দেয়। কারণ আমরা এক জায়গায় জমায়েত হয়ে শীর্ষ বৈঠকের আনুষ্ঠানিক মূল সুর ‘অভিন্ন ভবিষ্যতের লক্ষ্যে’ একত্রিত হতে চাই। বিশেষ করে ব্রিটেন এবং ভারত কমনওয়েল্থভুক্ত সমস্ত রাষ্ট্রগুলির নাগরিকদের জন্য আরও সুষম, সমৃদ্ধ, নিরাপদ এবং সুস্হ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাই। এই পদক্ষেপগুলি হল-
· কমনওয়েল্থের মাধ্যমে সহ বিশ্বব্যাপি সুসংহত উদ্যোগের মাধ্যমে প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলা এবং বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০১৮ আয়োজক দেশ হিসাবে ভারতের ভূমিকা।
· কমনওয়েল্থভুক্ত রাষ্ট্রগুলি সাইবার নিরাপত্তার ব্যবস্হা উন্নয়নে সহায়তা প্রদান।
· কমনওয়েল্থভুক্ত রাষ্ট্রগুলি যাতে বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠনে বাণিজ্য সুবিধা চুক্তি রূপায়ন করতে পারে তার জন্য টেকনিক্যাল সহায়তা এবং কমনওয়েল্থভুক্ত ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলির অফিসের কাজের জন্য বর্ধিত সহায়তা।
প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্ব
ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্ব আমাদের যৌথ দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রে রয়েছে এবং আজ ও আগামী প্রজন্মের সমৃদ্ধির জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। আমাদের দুই দেশই এক প্রযুক্তি বিপ্লবের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা বিশেষ ধরনের জ্ঞানের অংশীদার হব, গবেষনা ও উদ্ভাবনে সহযোগিতা করব এবং আমাদের বিশ্বমানের উদ্ভাবন ক্লাস্টারগুলির মধ্যে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলবো। আমরা আমাদের নিজস্ব প্রযুক্তিগত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উচ্চমানের কর্ম সংস্হান সৃষ্টি করব, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করবো, বাণিজ্য ও বিনিয়োগে উৎসাহ দেব এবং অভিন্ন চ্যালেঞ্জগুলি একসাথে মোকাবিলা করবো।
আমাদের বিশ্বব্যাপি চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলায় আমরা ভবিষ্যতে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবো। ডিজিটাল অর্থনীতি, স্বাস্হ্য প্রযুক্তি, সাইবার নিরাপত্তা এবং পরিবেশ বান্ধব অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, স্মার্ট শহর গড়ে তোলা এবং ভবিষ্যতে চলাচল ও পরিবহনের ক্ষেত্রে কৃত্রিম মেধার মতো প্রযুক্তির সম্ভাবনা অনুধাবন করে সেটিকে কাজে লাগাবো। একইসঙ্গে আমাদের যুবকদের ভবিষ্যত কর্মদক্ষতা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেব।
আমাদের দুই দেশের ক্রমবর্ধমান দ্বিপাক্ষিক প্রযুক্তি অংশীদারিত্বের অঙ্গ হিসাবে ব্রিটিশ-ভারত প্রযুক্তি হাব গড়ে তোলার জন্য ব্রিটেনের উদ্যোগকে ভারত সরকার স্বাগত জানাচ্ছে। এই প্রযুক্তি হাব দু দেশের হাইটেক কোম্পানীগুলিকে এক জায়গায় নিয়ে আসবে। ফলে বিনিয়োগ এবং রপ্তানির সম্ভাবনা তৈরি হবে এবং ভবিষ্যতের পরিবহন, আধুনিক উৎপাদন এবং স্বাস্হ্য পরিষেবা ও ভারতের উন্নয়নকামী জেলাগুলির জন্য কর্মসূচিতে কৃত্রিম মেধার ব্যবহারের লক্ষ্যে এই প্রযুক্তি হাব অভিজ্ঞতা বিনিময়ের একটি নতুন মঞ্চ হিসাবে কাজ করবে। আমরা ব্রিটেনের আঞ্চলিক এবং ভারতের প্রাদেশিক পর্যায়ের প্রযুক্তি ক্লাস্টারগুলির মধ্যে একগুচ্ছ নতুন অংশীদারিত্ব গড়ে তুলে যৌথভাবে উদ্ভাবন ও গবেষনা ও উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেব। উভয় দেশের সরকারের সহযোগিতায় আমরা ইতিমধ্যেই ভারত ব্রিটিশ প্রযুক্তি কোম্পানীর সিইও-দের একটি জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এছাড়া টেক ইউকে এবং ন্যাশকম-এর মধ্যে দক্ষতা এবং নতুন প্রযুক্তি বিষয়ে একটি সমঝোতা সাক্ষর করেছি। এতে শিল্পকেন্দ্রিক শিক্ষানবিশ প্রকল্প রয়েছে। অন্যদিকে ফিনটেকের মতো প্রযুক্তিতে উৎসাহ দান এবং ভারতে শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভিত্তির সহায়তার জন্য আমরা একটি নতুন ইউকে ফিনটেক রকেটশিপ অ্যাওয়ার্ড চালু করেছি।
উভয় দেশই বিজ্ঞান, গবেষনা এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে দুই দেশের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাদের কাজে লাগিয়ে বিশ্বের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত চ্যালেঞ্জগুলির মোকাবিলায় উদ্যোগ নিয়েছি। ব্রিটেন হচ্ছে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক গবেষনা এবং উদ্ভাবন অংশীদার দেশ। ভারত ব্রিটেন নিউটন-ভাবা কর্মসূচি যৌথ গবেষনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে এবং ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ৪০ কোটি পাউন্ডেরও বেশি মূল্যের উদ্ভাবনমূলক কাজ হবে। স্বাস্হ্য ক্ষেত্রে আমাদের যৌথ কার্যকর সম্পর্কে আরও গভীর করে ভারত এবং ব্রিটেন এই উভয় দেশকেই বসবাসের পক্ষে নিরাপদ এবং স্বাস্হ্যকর করে তুলবো। এর জন্য স্বাস্হ্য ক্ষেত্রে কৃত্রিম মেধা এবং ডিজিটাল স্বাস্হ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানো হবে।
বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং আর্থিক লেনদেন
উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ ভারত এবং ব্রিটেনের মধ্যে একটি নতুন ও গতিশীল বাণিজ্যিক অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার বিষয়ে একমত হয়েছে। এছাড়া যেহেতু ব্রিটেন বর্তমানে তাদের স্বাধীন বাণিজ্য নীতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে তাই দু দেশের মধ্যে নতুন বাণিজ্যিক ব্যবস্হা গড়ে তোলার বিষয়েও নেতৃবৃন্দ একমত হন। উভয় দেশের মধ্যে বিনিয়োগ, বিনিময় এবং সহযোগিতা বৃদ্ধির বিষয়েও ঐক্যমত্য হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভারত-ব্রিটেন যৌথ বাণিজ্য পর্যালোচনা বৈঠকে সুপারিশ অনুসারে আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্র ভিত্তির কর্মপরিকল্পনা তৈরি করবো, বাণিজ্যের অন্তরায়গুলি দুর করবো এবং সহজে ব্যবসা করার উদ্যোগ নেব। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেন বেরিয়ে আসার পর দু দেশের মধ্যে একটি শক্তিশালী দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসার পর নির্গমন সংক্রান্ত চুক্তি রূপায়নের সময়ে ভারত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে চুক্তিগুলিতে ব্রিটেনের অংশগ্রহন অবশ্য অব্যাহত রাখা হবে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে আসার পর ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের অনুরূপ চুক্তি যাতে ব্রিটেনের সঙ্গেও করা যায় সে বিষয়েও উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে।
উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ আইনভিত্তিক বহুপাক্ষিক বাণিজ্যিক ব্যবস্হা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা স্বীকার করেন এবং সুষম বৃ্দ্ধি ও উন্নয়নের স্বার্থে অবাধ ও উন্মুক্ত বাণিজ্যিক লেনদেন বৃদ্ধির গুরুত্ব নিয়েও একমত হন। নেতৃবৃন্দ বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠনের সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রের সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং বাণিজ্য বিষয়ে যৌথ কর্মীগোষ্ঠীর অধীনে আলাপ-আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়েও তাদের আগ্রহের কথা বলেন। কারণ এই আলোচনা বিশ্বব্যাপি আইনভিত্তিক ব্যবস্হার প্রতি উভয় দেশের অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির অনুরূপ এবং এক্ষেত্রে বিশ্ববাণিজ্য সংগঠনের ভূমিকাকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বিগত ১০ বছরে ব্রিটেন জি-২০ ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে বৃহত্তম বিনিয়োগকারি এবং ভারত ব্রিটেনের চতুর্থ বৃহত্তম বিনিয়োগ প্রকল্পের মালিক। আমরা আমাদের অগ্রাধিকার বিষয়ে পারস্পরিক বোঝাপরার ভিত্তিতে বিনিয়োগের জন্য নতুন করে আলাপ-আলোচনা শুরু করবো এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের বিভিন্ন ধরনের সুবিধাগুলি পর্যালোচনা করবো।
ব্রিটেনে ভারতীয় বিনিয়োগে জন্য একটি পারস্পরিক ফাস্ট ট্র্যাক ব্যবস্হা গড়ে তুলে ভারতীয় শিল্পকে অতিরিক্ত সহায়তা প্রদানের জন্য ব্রিটেনের সিদ্ধান্তকে ভারত স্বাগত জানিয়েছে। দুই দেশই ভারত ব্রিটেন সিইও ফোরাম কতৃক প্রস্তাবিত ব্যবসায় সহযোগিতা সংক্রান্ত উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে ভারত এবং ব্রিটেনের পক্ষে সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে।
উভয় দেশই বিশ্বের আর্থিক লেনদেন এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে লন্ডন শহরের প্রধান ভূমিকাকে স্বাগত জানিয়েছে। টাকার দামে মশলার বন্ডের বিশ্ব ব্যাপি ব্যবসার পরিমানের প্রায় ৭৫ শতাংশ লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে ইস্যু করা হয়ে থাকে।
ভারত সরকার এবং ব্রিটিশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে ভারতে জাতীয় বিনিয়োগ এবং পরিকাঠামো তহবিলের আওতায় যে গ্রীণ গ্রোথ ইক্যুইটি ফান্ড গড়া হয়েছে তা ভারতের ক্রমবর্ধমান পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তিক্ষেত্রে অর্থের ব্যবস্হা করবে। উভয় দেশের পক্ষ থেকে ১২ কোটি পাউন্ড করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি সহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে এই তহবিলে মোট ৫০ কোটি পাউন্ডের একটি তহবিল গড়ে তোলা হবে। ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে ১৭৫ গিয়াওয়াট পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদনের যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে তা অর্জনে এই তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়া যাবে। এছাড়া পরিচ্ছন্ন পরিবহন ব্যবস্হা, জল এবং বর্জ্য পরিচালনের ক্ষেত্রেও এই তহবিল থেকে অর্থ মিলবে।
উভয় দেশ নিজেদের মধ্যে ফিন টেক ডায়লগ বা আর্থিক প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতার জন্য কমিটি গঠনকে স্বাগত জানিয়েছে। আর্থিক পরিষেবা ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে দেউলিয়া, পেনশন এবং বিমা সংক্রান্ত বাজার গড়ে তোলার জন্য টেকনিক্যাল সহযোগিতার একটি কর্মসূচি নেওয়া হবে। এবছর উভয় দেশের অর্থমন্ত্রীরা যখন দু দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং আর্থিক পরিষেবা সংক্রান্ত বৈঠকে মিলিত হবেন, এ বিষয়ে আরও সহযোগিতার ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হবে।
ভারত এবং ব্রিটেন আজকের বিশ্বায়িত পৃথিবীতে যোগাযোগের গুরুত্বকে স্বীকার করে। যোগাযোগ সংক্রান্ত যেকোনও উদ্যোগের ক্ষেত্রেই সু-প্রশাসন, আইনের শাসন, উন্মুত্ততা এবং স্বচ্ছতার নীতি মেনে সামাজিক এবং পরিবেশ সংক্রান্ত মান, আর্থিক দায়বদ্ধতার নীতি, উত্তরদায়িতা সম্পন্ন ঋণ পরিশোধ ব্যবস্হার কথা মাথায় রেখে শুরু করতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক আইন-কানুন, মানক, প্রচলিত প্রথার কথাও মাথায় রাখা দরকার।
দায়িত্বশীল বিশ্ব নেতৃত্ব
উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধ লড়ায়ের নেতৃত্বদানের প্রতি তাঁদের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। উভয় দেশই মনে করে, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবিলা এবং নিরাপদ, সুলভ ও সুষম শক্তি সরবরাহের ব্যবস্হা দুই দেশেরই অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এক বিষয়। এরই প্রেক্ষিতে উভয় দেশ প্রযুক্তি উদ্ভাবন, অভিজ্ঞতা বিনিময়, পরিকাঠামো গড়ে তোলা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং প্রকল্প স্হাপনের মাধ্যমে পরিচ্ছন্ন শক্তির প্রকল্পগুলি ব্যয় হ্রাস করার জন্য সহযোগিতার বিষয়ে একমত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সৌরজোটের মতো একটি শক্তিজোট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভারতের সক্রিয় পদক্ষেপকে ব্রিটেন স্বাগত জানিয়েছে। কমনওয়েল্থ রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ বৈঠকের সপ্তাহে দু দেশের সরকারের সহযোগিতায় লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ এবং আন্তর্জাতিক সৌরজোটের মধ্যে সফল বৈঠকে উভয় দেশই সন্তোষ ব্যক্ত করেছে। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই ব্রিটেন এই অনুষ্ঠানে যোগদান করেছে। সৌরজোটের মূল লক্ষ্য অর্জনে এই জোট এবং ব্রিটেনের মধ্যে সৌরশক্তি উৎপাদনে আর্থিক সহায়তা, পরবর্তী প্রজন্মের সৌরপ্রযুক্তি এবং এক্ষেত্রে ব্রিটেনের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক সৌরজোটভুক্ত দেশগুলিতে সৌরশক্তির প্রসারের লক্ষ্যে ১ লক্ষ কোটি ডলার বিনিয়োগের ব্যবস্হা করতে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
গতিশীল গণতন্ত্র হিসাবে আমরা একটি নিয়মবদ্ধ আন্তর্জাতিক ব্যবস্হাকে সমর্থন করার লক্ষ্যে একযোগে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছি। এই অনিশ্চিত পৃথিবীতে ভারত এবং ব্রিটেন যৌথভাবে এক শুভ শক্তি হিসাবে কাজ করতে পারে। বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানকে ভাগ করে নিতে চায়। ভারতের জৈব প্রযুক্তি দপ্তর এবং ব্রিটেনের ক্যান্সার গবেষনা সংগঠন যৌথ উদ্যোগে ১ কোটি পাউন্ডের একটি দ্বিপাক্ষিক গবেষনা উদ্যোগ শুরু করতে চাই। সুলভে ক্যন্সার চিকিৎসাই এই উদ্যোগের লক্ষ্য হবে। এছাড়া ব্রিটেনের জৈব প্রযুক্তি এবং জৈব বিজ্ঞান গবেষনা পরিষদ ও ভারতের জৈব প্রযুক্তি দপ্তর যৌথভাবে আধুনিক কৃষির উন্নতিকল্পে একটি ‘কৃষক জোন’ নামে এক উদ্যোগ গড়ে তুলবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে শুধুমাত্র আমাদের দুই দেশই উপকৃত হবে তাই নয়, বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকের জীবনকে উন্নত করে তোলা সম্ভব হবে। অন্যদিকে ব্রিটেনের প্রাকৃতিক পরিবেশ গবেষনা পরিষদ এবং ভারতের জৈব প্রযুক্তি দপ্তর যৌথভাবে একটি সুষম বিশ্ব নামে উদ্যোগ গড়ে তুলতে চায়, যার মাধ্যমে সুষম এবং স্হায়ী মানবিক উন্নয়নের জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গবেষনা এবং উদ্ভাবনের কাজ চালানো হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে সমগ্র বিশ্ব থেকে অপরিসীম দারিদ্রকে সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলতে বিশ্বের উন্নয়নের কাজে আমরা আমাদের অংশীদারিত্বকে আরও জোরদার করে তুলবো। যতোগুলি দেশে সম্ভব, আমরা আর্থিক সহায়তা, নতুন বাজারের ব্যবস্হা, বাণিজ্য বিনিয়োগ, যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক সংহতির ক্ষেত্রে আমরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেব।
প্রতিরক্ষা এবং সাইবার নিরাপত্তা
২০১৫ সালে আমরা একটি নতুন প্রতিরক্ষা এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার শপথ নিয়েছিলাম। এই অংশীদারিত্বের মূল সুর ছিল প্রতিরক্ষা এবং নিরাপত্তাকে আমাদের সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু করে তোলা। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলির আমরা মুখোমুখি হই, তা প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে আমাদের প্রস্তুতির জন্য আরও বেশি উদ্ভাবনশীলতা এবং দক্ষতার প্রয়োজন। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা মোকাবিলায় আমরা নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করবো এবং আমাদের দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে এই প্রযুক্তি, দক্ষতা এবং যন্ত্রপাতি ভাগ করে নেব।
ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলটি নিরাপদমুক্ত অন্তর্ভুক্ত এবং সমৃদ্ধ হয়ে উঠলে তা যে কেবলমাত্র ভারত ও ব্রিটেনের স্বার্থরক্ষা করবে তাই নয়, এর ফলে আর্ন্তজাতিক গোষ্ঠীরও স্বার্থ সুরক্ষিত হবে। ভারত এবং ব্রিটেন এই অঞ্চলটিতে জলদস্যুতা প্রতিরোধ, জাহাজ চলাচলের স্বাধীনতা এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একযোগে কাজ করবে।
সাইবার দুনিয়াতেও আমরা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা এবং স্হিতিশীলতাকে তুলে ধরতে আমাদের সহযোগিতাকে আরো বৃদ্ধি করতে একমত হয়েছি। তবে, এই সহযোগিতা হবে একটি মুক্ত, অবাধ, শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ সাইবার দুনিয়ায় আন্তর্জাতিক আইন-কানুনগুলি যথাযথভাবে স্বীকৃতি এবং কার্যকর করার মাধ্যমে।
সন্ত্রাসবাদ বিরোধীতা
উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ পুনরায় যে কোনও ধরনের সন্ত্রাসবাদের তীব্র নিন্দা করেন এবং ভারত ও ব্রিটেনে এই ধরনের সন্ত্রাসমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্হা গ্রহন বিষয়ে একমত হন। উভয় নেতাই কোনও পরিস্হিতিতেই সন্ত্রাসবাদের যৌক্তিকতা মেনে নেওয়া হবে না বলে তাদের ঘোষিত অবস্হানের প্রতি দৃঢ় আস্হা ব্যক্ত করেন। ধর্ম, গোষ্ঠী, জাতীয়তা বা জনগোষ্ঠী কোনোকিছুর ভিত্তিতেই সন্ত্রাসবাদের যৌক্তিকতা মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলে উভয় দেশ সুষ্পষ্টভাবে অভিমত ব্যক্ত করে।
উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ সন্ত্রাসবাদী এবং সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলি যাতে কোনওভাবেই নিরীহ মানুষকে তাদের আদর্শে দীক্ষিত করতে না পারে, তাদের সংগঠনে নিয়োগ করতে না পারে, সে বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্হা গ্রহনের প্রয়োজনীতার বিষয়ে একমত হন। এই লক্ষ্য অর্জনে বিশ্বের সব দেশকে একযোগে সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্ক, তাদের অর্থ যোগান, চলাচল প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে বলে উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ অভিমত প্রকাশ করেন।
সারা বিশ্বের নিষিদ্ধ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ও সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্হা গ্রহনে উভয় দেশ তাদের সহযোগিতাকে আরও জোরদার করার ব্যাপারে একমত হয়। লস্কর-এ-তৈইবা, জৈইস-এ-মহম্মদ, হিজ্ব-উল-মুজাহিদিন, হাক্কানি নেটওয়ার্ক, আল-কায়দা, আইএসআইএস (দাইয়েস) এবং তাদের সহকারি যেসব সংগঠন রয়েছে তাদের আক্রমনের হাত থেকে আমাদের দুই দেশের নাগরিকদের সুরক্ষিত রাখা এবং অন-লাইন ব্যবস্হার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী আদর্শকে ছড়িয়ে দেওয়া ও হিংসার বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্হা গ্রহনের ক্ষেত্রেও উভয় দেশ একমত হয়েছে।
সালিসবেরিতে যে ভয়ানক রাসায়নিক নার্ভ এজেন্ট ব্যবহার করে হামলা চালানো হয়েছে, তারই প্রেক্ষিতে ভারত এবং ব্রিটেন রাসায়নিক অস্ত্রশস্ত্রের প্রসার ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে নিরস্ত্রীকরণ ও প্রসার প্রতিরোধ ব্যবস্হাকে শক্তিশালী করে তোলার বিষয়ে উভয় দেশই একমত হয়েছে। সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের বিরুদ্ধে উভয় দেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিশ্বের যে কোনও স্হানে, যে কোনও ভাবে, যে কোনও সময়ে এবং যে কোনও পরিস্হিতিতে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের তীব্র বিরোধীতা করে উভয় দেশ আন্তর্জাতিক রাসায়নিক অস্ত্র প্রতিরোধ সংক্রান্ত চুক্তিকে যথাযথভাবে রূপায়নের ওপর জোর দিয়েছে। রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের যে কোনোও ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক রাসায়নিক অস্ত্র প্রতিরোধ চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জরুরি ভিত্তিতে তদন্তের ওপরেও উভয় দেশ জোর দিয়েছে।
শিক্ষা এবং মানুষে মানুষে যোগাযোগ
আমরা যেসব বিষয় এবং ক্ষেত্রে দক্ষতা এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে উভয় দেশের সমৃদ্ধি সুনিশ্চিত হবে, সেইসব ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ এবং উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা ও কাজ করার বিষয়টি স্বাগত জানায়।
২০১৭ সালে ভারত-ব্রিটেন সংস্কৃতি বর্ষ উদযাপনের সাফল্যে উভয় নেতাই সন্তোষ ব্যক্ত করেন। এক বছর ব্যাপি এই বর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে নজিরবিহীনভাবে দু দেশের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিনিময়ের এবং শিল্পকলা, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরার সুযোগ এসেছিল বলে দু দেশের নেতৃবৃন্দ উল্লেখ করেছেন।
উভয় নেতায় ভারতের ব্রিটিশ কাউন্সিলে ৭০তম বর্ষ উদযাপন এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ, যুবকদের দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে এই সংগঠনের ভূমিকাকে স্বাগত জানিয়েছে।
উভয় দেশের নেতৃবৃন্দ মনে করেন, দুই দেশের মানুষের মধ্যে সচল সেতুবন্ধের মাধ্যমেই ভারত ও ব্রিটেনের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে যোগাযোগ ও বিনিময়ের আশা নিহিত রয়েছে। এই জীবন্ত সেতুবন্ধকে উভয় নেতায় উৎসাহিত এবং সমর্থন করতে রাজি হয়েছেন।
উপসংহার
আমরা আমাদের এই কৌশলগত অংশীদারিত্বকে, যা বিশ্বব্যাপি শতাব্দী জুড়ে ছড়িয়ে আছে, আগামী দিনে আরও বেশি করে উজ্জীবিত করার জন্য দৃঢ় সংকল্প। দু-দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং বুদ্ধিজীবি ও নেতৃবৃন্দের মধ্যে প্রতিনিয়ত যে যোগাযোগ হচ্ছে, তাকে কাজে লাগানোর জন্য উৎসাহ দিই। এই যোগাযোগ পরিবার থেকে অর্থিক, ব্যবসা থেকে বলিউড এবং ক্রীড়া থেকে বিজ্ঞান সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। একে কাজে লাগিয়ে ভারত ও ব্রিটেন যাতে আরও বেশি করে শিক্ষা, পর্যটন এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে এবং ব্রিটিশ সরকারকে তাঁর প্রতি এবং তাঁর প্রতিনিধিদলের সদস্যদের প্রতি উষ্ণ আতিথিয়েতা প্রদর্শনের জন্য ধন্যবাদ জানান এবং তাঁকে ভারতে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করে হবে বলে জানান।
CG/PB/NS/