২০১৪ সালের ২৬ মে সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনের প্রাঙ্গণে ইতিহাস রচিত হয়। ঐ দিন নরেন্দ্র মোদী ভারতের মানুষের কাছ থেকে এক ঐতিহাসিক জনাদেশ পেয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে ভারতের মানুষ একজন প্রাণবন্ত, স্থিরমতি এবং উন্নয়নমুখী নেতাকে দেখেছেন। যিনি শতকোটি ভারতীয়ের আশা-আকাঙ্খা রূপায়ণে এক আলোর প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। উন্নয়নের ওপর তাঁর জোর, খুঁটিনাটি বিষয়ে তাঁর নজরদারি ও দরিদ্রদের মধ্যে দরিদ্রতম মানুষদের জীবনে গুণগত পরিবর্তনে তাঁর উদ্যোগ নরেন্দ্র মোদীকে একজন জনপ্রিয় এবং শ্রদ্ধাভাজন নেতা হিসাবে দেশে সর্বত্র প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
নরেন্দ্র মোদীর জীবন যেন সাহস, করুণা এবং নিরবচ্ছিন্ন কঠোর পরিশ্রমের এক অভিযাত্রা। খুব কম বয়সে তিনি মানুষের সেবায় নিজের জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। তৃণমূল স্তরের কর্মী হিসাবে, সংগঠক হিসাবে এবং তাঁর নিজের রাজ্য গুজরাটের ১৩ বছর মুখ্যমন্ত্রীত্বের কার্যকালের মেয়াদে প্রশাসক হিসাবে তাঁর দক্ষতা তিনি তুলে ধরেছেন। যেখানে, মানুষের জন্য এবং সুপ্রশাসনের জন্য তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে তিনি এক অসাধারণ পরিবর্তনসাধন করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণের আগে নরেন্দ্র মোদী অনুপ্রেরণাময় জীবনের শুরু হয় উত্তর গুজরাটের মেহসানা জেলার ভাদনগর নামের এক ছোট শহরের অলিগলিতে। ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম হয়। তার ঠিক তিন বছর আগেই ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। এজন্য তিনি স্বাধীন ভারতে জন্মানো ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। তিনি দামোদরদাস মোদী এবং হীরাবাঈ মোদীর তৃতীয় সন্তান। তিনি অত্যন্ত দরিদ্র এক পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তাঁদের পুরো পরিবার ৪০ ফুট X ১২ ফুট একটি একতলা বাড়িতে থাকতেন।
নরেন্দ্র মোদীর চরিত্র গঠনের প্রথমদিকের বছরগুলিতে তিনি কঠোরতার শিক্ষা পান। একইসঙ্গে, তিনি তাঁর পড়াশোনা এবং অবসর সময়ের মধ্যে সমতাবিধান করে পারিবারিক চায়ের দোকানে সময় দিতেন। কারণ, তাঁর পরিবার জীবিকা নির্বাহের জন্য এই কাজ করত। তাঁর স্কুলের বন্ধুদের স্মৃতিচারণে জানা যায়, বালক বয়সে তিনি ছিলেন পরিশ্রমী, বিতর্কের প্রতি তাঁর ঝোঁক এবং নতুন নতুন বই পড়ার আগ্রহ তাঁর ছিল। স্কুলের বন্ধুরা জানিয়েছেন, কিভাবে শ্রী মোদী স্থানীয় গ্রন্থাগারে ঘন্টার পর ঘন্টা পড়াশুনা করতেন। সেই বয়সে তিনি সাঁতার কাটতেও ভালোবাসতেন।
শিশু বয়সে শ্রী মোদীর চিন্তা-ভাবনা এবং স্বপ্ন তাঁর বয়সের অন্যান্যদের তুলনায় ছিল অনেকটাই আলাদা। হয়তো, তাঁর চরিত্রে বহু শত বছর আগে বৌদ্ধধর্মের শিক্ষা এবং দর্শনের কেন্দ্র হিসাবে ভাদনগরের প্রভাব পড়েছিল। বাল্য বয়সেই তাঁর মনে সমাজে পরিবর্তন আনার এক স্পৃহা তিনি অনুভব করতেন। তিনি স্বামী বিবেকানন্দের কাজে বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। স্বামীজির প্রভাবেই তাঁর ভাবজগতের অভিযাত্রা শুরু হয়, যা তাঁকে ভারত’কে জগতের শ্রেষ্ঠ হিসাবে পরিণত করার স্বামীজির স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দেয়।
সতেরো বছর বয়সে তিনি বাড়ি ছেড়ে ভারত পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়েন। দু’বছর ধরে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করে বৈচিত্র্যময় ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন। বাড়ি ফিরে আসার পর তিনি এক পরিবর্তিত মানুষে পরিণত হন। যে মানুষটির মধ্যে জীবনে যা তিনি অর্জন করতে চান তার একটি সুস্পষ্ট লক্ষ্য তৈরি হয়েছে। তিনি আমেদাবাদে গিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে যোগ দেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আর.এস.এস.) ভারতের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে কর্মরত এক সমাজ-সংস্কৃতিমূলক এক সংগঠন। ১৯৭২ সালে আমেদাবাদে গিয়ে তিনি যখন আর.এস.এস. – এর প্রচারক হিসাবে কাজ শুরু করেন তখন তাঁর জীবন ছিল কঠোর পরিশ্রমের। তাঁর দিন শুরু হত ভোর পাঁচটায় এবং গভীর রাত্রে তা শেষ হত। ১৯৭০ – এর দশকের শেষের দিকে যুবক নরেন্দ্র মোদী জরুরি অবস্থায় বিপর্যস্ত ভারতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে যোগ দেন।
১৯৮০’র দশকে সঙ্ঘের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে একজন আদর্শ সংগঠক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। ১৯৮৭ সালে গুজরাটে বি.জে.পি.’র সাধারণ সম্পাদক হিসাবে তাঁর জীবনে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। নতুন দায়িত্বে তাঁর প্রথম কাজ ছিল আমেদাবাদ নগর নিগমের নির্বাচনে বি.জে.পি.’র প্রথম জয়লাভ নিশ্চিত করা। এছাড়া, ১৯৯০ সালে গুজরাটে বিধানসভা নির্বাচনে বি.জে.পি. যাতে কংগ্রেসের পরেই দ্বিতীয় স্থান দখল করে তাও তিনি নিশ্চিত করেন। ১৯৯৫ সালে বিধানসভা নির্বাচনে শ্রী মোদীর সাংগঠনিক দক্ষতার মাধ্যমে বি.জে.পি.’র জনসমর্থন বৃদ্ধি পায়। এই বিধানসভা নির্বাচনে বি.জে.পি. ১২১টি আসন লাভ করে।
১৯৯৫ সাল থেকে শ্রী মোদী বি.জে.পি.’র জাতীয় পর্যায়ের সম্পাদক হিসাবে হরিয়ানা এবং হিমাচলপ্রদেশের সাংগঠনিক দায়িত্ব পান। বি.জে.পি.’র সাধারণ সম্পাদক হিসাবে ১৯৯৮ সালের লোকসভা নির্বাচনে বি.জে.পি.’র জয় নিশ্চিত করার জন্য তিনি কাজ করে যান। ২০০১ – এর সেপ্টেম্বর মাসে শ্রী মোদী তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী বাজেপেয়ীর কাছ থেকে একটি ফোন পান। তার পর থেকেই তাঁর জীবনে নতুন আরেকটি অধ্যায়ের সূচনা হয়। এই পর্যায়ে সাংগঠনিক রাজনীতির কঠিন এবং কঠোর পথ থেকে তিনি প্রশাসনে যোগ দেন। নরেন্দ্র মোদীর জীবনের বাকি অংশ জানতে http://www.narendramodi.in/humble-beginnings-the-early-years/ – এ ক্লিক করুন।
বি.জে.পি.’র সংগঠনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি থেকে দেশের অন্যতম সুপ্রশাসক হিসাবে স্বীকৃত এক নেতা হিসাবে এক দশকে নরেন্দ্র মোদীর উত্থানে লুকিয়ে আছে সহজাত দৃঢ়তা এবং প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যেও শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রদানের এক অসাধারণ কাহিনী। রাজনৈতিক সংগঠন থেকে নরেন্দ্র মোদীর প্রশাসনিক জীবনে কর্মপরিবর্তনে তিনি সময় বা প্রশিক্ষণের কোনও সুযোগ পাননি। প্রশাসনিক জীবনের প্রথমদিন থেকেই শ্রী মোদী’কে কাজের মধ্য দিয়েই প্রশাসনের রীতিনীতির বিষয়ে শিক্ষা নিতে হয়েছে। প্রশাসক হিসাবে কাজের মেয়াদের প্রথম ১০০ দিনেই নরেন্দ্র মোদী দেখিয়েছেন কিভাবে তাঁর মধ্যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই পরিবর্তন প্রভাব ফেলেছে। শুধু তাই নয়, এই ১০০ দিনের কাজের সময়কালেই তিনি এও দেখিয়েছেন কিভাবে বাঁধা গতের বাইরে গিয়ে স্থিতিশীলতার পরিবর্তন করতে হয় এবং প্রশাসনিক সংস্কার করতে হয়।
উন্নয়ন এবং সুপ্রশাসনের উজ্জ্বল উদাহরণ হিসাবে জাগ্রত গুজরাট সৃষ্টি করতে নরেন্দ্র মোদীর রাস্তা মোটেই সহজ ছিল না। এই রাস্তা ছিল প্রতিকূলতা এবং চ্যালেঞ্জে ভরা। গত এক দশক ধরে নরেন্দ্র মোদীর চরিত্রের যে বৈশিষ্ট্যটি অপরিবর্তিত থেকেছে, তা হল – প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁর নেতৃত্বদানের শক্তি। সুপ্রশাসনের ক্ষেত্রে নরেন্দ্র মোদীর দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে তিনি সবসময়েই রাজনীতির উর্ধ্বে উঠতে চেয়েছেন। উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কাজে শ্রী মোদী কখনই রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে প্রতিবন্ধক হতে দেননি। যখন শ্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণের প্রস্তুতি শুরু করেছেন তখনও প্রশাসন এবং সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে মিলিয়ে দেবার চিন্তাভাবনা কাজ করেছে। ‘ন্যূনতম সরকার, সর্বাধিক সরকারি পরিচালনামূলক কাজ’ – শ্রী মোদীর এই দর্শনের সবচেয়ে সুন্দর নিদর্শন হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ সুপ্রশাসনের জন্য তাঁর ‘পঞ্চ – অম্রুত’ সংগঠন ভাবনা।
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছ থেকে তিনি যেসব পুরষ্কার পেয়েছেন তার মধ্যেই তাঁর কাজের স্বীকৃতি প্রতিফলিত হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদী ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যের সবচেয়ে সফল মুখ্যমন্ত্রী এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রশাসকের সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা সঙ্গে এনেছেন।